eaibanglai
Homeউত্তর বাংলাফ্রিডম অফ প্রেস এবং ভারতের অবস্থান

ফ্রিডম অফ প্রেস এবং ভারতের অবস্থান

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- শুধু এই দেশে নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একদল সাহসী সাংবাদিকের কলমে বারবার ফুটে উঠেছে প্রকৃত চিত্র। তাদের মিলিত গর্জনে কেঁপে ওঠে শাসকের পায়ের তলার মাটি। মত প্রকাশের স্বাধীন অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সংবাদ মাধ্যম ও তার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের উপর প্রায়শই নেমে আসে নির্মম আঘাত। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে  সরকার সহ সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালে তাদের সাধারণ সভায় ৩ মে দিনটি ‘বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর প্রতিবছর একটি স্লোগানকে সামনে রেখে দিনটি, একদিনের জন্য হলেও’ যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে পালন করা হয়। বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবসের ২০২৫ সালের স্লোগান হলো – ‘সাহসী নতুন বিশ্বে রিপোর্টিং – প্রেস স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের উপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব’।

ভারতীয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলো সংবাদ মাধ্যম, সংবিধানের প্রকৃত ‘চৌকিদার’। যেখানে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতে ভয় পায়, সেখানেই গর্জে ওঠে সাংবাদিকদের কলম। ফুটে ওঠে দুর্নীতির কাহিনী, মানুষের দুর্দশার করুণ চিত্র। সাধারণ মানুষ সংবাদ মাধ্যমের উপর ভরসা রাখে। নিজেদের বক্তব্য সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সংবাদ মাধ্যমের উপর নির্ভর করে। অনেক ঘটনা সরকার চেপে দেওয়ার চেষ্টা করলেও সাংবাদিকদের জন্যেই সব সময় তাদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়না।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইথআউট বডার্স’ এর ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সূচক’ -এর শেষ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের ১৮০ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৬১ নম্বরে। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এটা বড় লজ্জার!

বিরোধীদের বক্তব্য বিজেপির ঘৃণার রাজনীতি সংবাদ মাধ্যম তথা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। সরকারের সমালোচনা করলেই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের গায়ে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহীর তকমা অথবা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে মিডিয়া হাউসকে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা হচ্ছে।

তবে সাংবাদিক নিগ্রহের ক্ষেত্রে শাসক ও বিরোধী উভয় দলের মধ্যে একটা অলিখিত মিল দেখা যায়। প্রতিটি রাজ্যের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে শাসক দলের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেনা সাংবাদিকরা, তাদের উপর আক্রমণ নেমে আসছে। তারপরও নির্লজ্জের মত একে অপরের সমালোচনা করে যাচ্ছে। এমন ভাব দেখাচ্ছে নিজ নিজ শাসিত রাজ্যে সাংবাদিকরা নির্ভয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তাই নাকি!

আসলে দেশের কোনো রাজনৈতিক দল কখনোই নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো অস্বস্তিকর প্রশ্ন পচ্ছন্দ করেনা। তারা চায়না তাদের দিকে কেউ অভিযোগের আঙুল তুলুক। অথচ নানান চাপ সহ্য করেও একদল সাহসী সাংবাদিক সেই কাজটাই করে। সত্যটা জনগণের সামনে আনে। এটা কী সহ্য করা যায়!

বিজেপির নেতাদের যদি প্রশ্ন করা হয় – ভয় না থাকলে তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সম্পর্কে ওঠা অভিযোগ নিয়ে জেপিসি করতে সমস্যা কোথায়? কোন আশঙ্কায় দেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে ভয় পান? বামেদের যদি প্রশ্ন করা হয় সিঙ্গুর নিয়ে টাটার সঙ্গে চুক্তি কেন সামনে আনা হলোনা? এতো কোনো বিদেশী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি নয়? তৃণমূলকে যদি প্রশ্ন করা হয় – জোর গলায় বলুন দলের কোনো নেতা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নয়? এসব প্রশ্ন করলেই রেগে যাবে।

কংগ্রেসকে যদি প্রশ্ন করা হয়, জরুরি অবস্থার সময় কেন একাধিক প্রথম সারির সাংবাদিককে জেলে বন্দী করা হয়েছিল? কি ছিল তাদের অপরাধ? এরপরও কংগ্রেস কি করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে বলে মোদী সরকারের দিকে আঙুল তোলে?

বাম আমলে ‘না পড়লে পেছিয়ে পড়তে হয়’ দৈনিক পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে কেন বন্ধ করে রাখা হয়েছিল? ‘ভগবানকে ছাড়া কাউকে ভয় পাইনা’ পত্রিকাটি নিয়ে কলেজ যাওয়ার অপরাধে কেন জনৈক ছাত্রকে আঘাত করা হয়েছিল? সেই সময় দলের মুখপত্র ছাড়া অন্য কাগজের সাংবাদিকরা কি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেত? তখন আজকের মত সোশ্যাল মিডিয়া বা হাতে হাতে স্মার্টফোন থাকলে বোঝা যেত সাংবাদিকরা কতটা স্বাধীনতা ভোগ করত। কতটা তারা নিরাপদ ছিল।

উত্তরপ্রদেশে সিদ্দিক কাপ্পান বা মধ্যপ্রদেশে সাংবাদিকদের নগ্ন করে জেলে ভরে দেওয়া হয়। সরকারকে প্রশ্ন করার অপরাধে পুণ্য প্রসূণ বাজপেয়ী, অভিসার শর্মা বা রভিশ কুমারদের চাকরি চলে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলায় তদন্তের মুখে পড়তে হয় এই রাজ্যের একটি বৈদ্যুতিন মাধ্যমকে। পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, সুবোধ বর্মা সহ একাধিক প্রবীণ সাংবাদিকের বাড়িতে তল্লাশি সহ জেরা করা হয়।সরকারের দিকে অস্বস্তিকর প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার অপরাধে নিউজ়ক্লিক’-এর সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ ও অমিত চক্রবর্তীকে ‘সন্ত্রাস দমন’ আইনে গ্রেপ্তার করা হয়।

এটা ঠিক সব সাংবাদিক ধোয়া তুলসী পাতা নয়। অনেক সময় সরকারকে হেনস্থা করার জন্য তারা ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য সম্প্রচার করে। অন্য রাজ্যের হিংসার ঘটনাকে তারা এই রাজ্যের বলে চালিয়ে দেয়চেষ্টা। বহু পোর্টাল, ইউটিউবার ও মেইন স্ট্রীমের সংবাদ মাধ্যম আছে যাদের ক্ষেত্রে আগাম অনুমান করে নেওয়া যাবে তারা কি বলতে চলেছে। কোনো মিডিয়া হাউসের কাছ থেকে এটা কখনোই কাম্য নয়। মাথায় রাখতে হবে তারা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের সৈনিক।

কর্মক্ষেত্রে পেশাগত বিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ নাহওয়ার জন্য সাংবাদিকদের উপর বারবার আঘাত নেমে আসছে। কাউকে ‘দু-পয়সার সাংবাদিক’ বলা হলে আমরা প্রতিবাদ করি কিন্তু যখন ‘চটিচাটা’ বা ‘দলদাস’ বলা হয় তখন নীরব থাকি। আশির দশকে কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ মাধ্যমের উপর অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করলে দেশের প্রায় সমস্ত সংবাদ মাধ্যম ঐক্যবদ্ধ ভাবে পরপর বেশ কয়েকদিন সম্পাদকীয় কলম ‘ব্ল্যাক আউট’ করে দেয়। সরকার নির্দেশটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ঐক্যবদ্ধ হলে রাজনৈতিক দল এবং লুম্পেনরা আঘাত করার আগে ভাবতে বাধ্য হবে। তবে রাজনৈতিক আল্লাখাল্লা গায়ে চড়িয়ে প্রতিবাদ করলে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়না।

বিভিন্ন কারণে ও আর্থিক অনিশ্চয়তা আজ গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের সৈনিক সাংবাদিকদের অসহায় করে তুলেছে। সাংবাদিকরা যাতে নির্ভয়ে কাজ করতে পারে এবং আর্থিক অনিশ্চয়তায় না ভোগে তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সাংবাদিকদেরও নিজ পেশার মর্যাদা রক্ষার জন্য সচেতন হতে হবে। তবেই কিন্তু ‘ফ্রিডম অফ প্রেস’ শব্দবন্ধনী অর্থবহ হয়ে উঠবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments