সঙ্গীতা চৌধুরীঃ- মহালয়ার পরদিন থেকেই শুরু হয় নবরাত্রি আর নবরাত্রীর এই নয়টি দিনেই মা নয় রূপে আবির্ভূতা হন। মায়ের এই সকল রূপগুলোর আসল অর্থ কী? মায়ের এই রূপ গুলোর তাৎপর্যই বা কী? তা বলতে গিয়ে স্বামী সোমেশ্বরানন্দ মহারাজ বলেছেন, নয়টি রূপ আসলে শক্তির সাধনার নয়টি স্তর। এক একটি রূপের আরাধনা করতে গিয়ে সাধকের এক এক রকম অনুভূতি হয়। প্রতিপদ থেকে নবমী মায়ের এই নয়টি রূপের তাৎপর্য বুঝিয়েছেন তিনি তার মতো করে।
মহারাজের কথায়, “প্রতিপদে শৈলপুত্রী -শীলা’র কন্যা অর্থাৎ হিমালয়ের মেয়ে। পাহাড় জড়, কিন্তু তার ভেতরে আছে রত্ন-ভাণ্ডার। খনিজ পদার্থে ভরা। সাধনার প্রথম অবস্থায় মানুষ জড় বা তামসিক যদিও তার মধ্যে রয়েছে অসীম সম্ভাবনা।
দ্বিতীয়ায় ব্রহ্মচারিণী- ব্রহ্মে যিনি পদচারণা করেন বা থাকেন। সাধনার দ্বিতীয় স্তরে সাধক তামসিক অবস্থা থেকে উঠে ঈশ্বরচিন্তা শুরু করেছেন।
তৃতীয়ায় চন্দ্রঘন্টা -মায়ের মাথায় চাঁদ, হাতে ঘন্টা। এই স্তরে নানা অনুভূতি হয় সাধকের। সাদা উজ্জ্বল জ্যোতি দর্শন (চাঁদ), দিব্য শব্দ (ঘন্টা) ইত্যাদি অনুভব হতে থাকে।
চতুর্থীতে কুষ্মান্ডা- কু(খারাপ)+উষ্ম(গরম)+অন্ড(পেট) = সাধকের যে কষ্ট (কু), সেই অসহ্য (উষ্ম) যিনি খেয়ে ফেলেন বা দূর করেন তিনিই কুষ্মান্ডা। প্রাথমিক সংগ্রামের পর সাধকের গতি এই স্তর থেকে দ্রুত হতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন যে দিব্যশক্তির সাহায্য তিনি পাচ্ছেন।
পঞ্চমীতে স্কন্দমাতা -স্কন্দ অর্থাৎ কার্তিকের মা। দেবদেবীদের সেনাবাহিনীর (শক্তির) যিনি প্রধান শক্তি সেই শক্তিমানের মা। সৃষ্টির আদি শক্তি। এই স্তরে সাধক নিজেকে অনুভব করেন চেতন শক্তি রূপে। দেহ ও মনকে অতিক্রম করে তিনি নিজ অস্তিত্বের গভীর চেতনায় চলে যান। দেহ বোধ আর নেই, মনের চিন্তা ও আবেগ শান্ত। সাধক নিজেকে অনুভব করছেন স্থির চেতনা হিসেবে, বুঝতে পারছেন যে দেহ ও মন যেন দুই পর্দা যা চেতনাকে ঢেকে ছিল এতদিন।
ষষ্ঠীতে কাত্যায়নী -কাত্যায়ন ঋষি মা দুর্গাকে নিজের কন্যা রুপে সাধনা করতেন (বাৎসল্য ভাব)। মা তাই তাঁকে ওই রূপেই দেখা দিয়েছিলেন। মা তাই কাত্যায়নের মেয়ে কাত্যায়নী। আরেক অর্থ, কাত্য=ব্রহ্মজ্ঞানী। অয়ন=পথ। কিভাবে লোক-কল্যাণ করতে হবে এটা যিনি ব্রহ্মজ্ঞানীদের বলেন, সেই মা দুর্গা। এই স্তরে সাধক তার নতুন অর্জিত শক্তির অপপ্রয়োগ না করে যাতে দিব্য সত্বার নির্দেশে চলেন তারই চেষ্টা করেন। কারণ তা না হলে সাধকের পতন হতে পারে।
সপ্তমীতে কালরাত্রি মা ঘন কৃষ্ণ বর্ণ নিয়ে আবির্ভুতা। কালী রুপে দেখা দেন। সাধনার এই স্তরে পুরনো জগৎ বিলীন হয়ে গেছে। যে জগতে সাধক এতকাল অসংখ্য জন্ম কাটিয়েছেন, তা যে অন্ধকারের মধ্যে থাকা সেটা বুঝতে পারছেন। বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন পরিণত হয়েছে বিশাল সর্বগ্রসী ব্ল্যাক-হোলে। সাধকের কাছে সর্বশুন্য অনুভব।
অষ্টমীতে মহাগৌরী মা এখানে আবির্ভূত হন সর্বব্যাপী আলো রূপ নিয়ে। কালী রূপের পর মা দেখা দেন দুর্গা রূপে। কালী রূপে মা পরীক্ষা করেছেন সাধককে, সে কি চরম সত্য বা ঈশ্বরের জন্য সব আকর্ষণ ত্যাগ করতে পারবে? এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই মা আসবেন তাঁর অসীম ঐশ্বর্য নিয়ে। সাধক উত্তীর্ণ। মা তাই মহা-গৌরীরূপে আবির্ভূতা।
নবমীতে সিদ্ধিদাত্রী মা এবার সিদ্ধি দান করার জন্য উপস্থিত। সাধক এতকাল শক্তির নানা রূপ দেখেছেন। এই স্তরে তিনি অনুভব করেন মায়ের অব্যক্ত সত্তাকে। এতদিন সাগরের ছোট-বড় অসংখ্য ঢেউ দেখেছেন, এবার সাগরকে অনুভব করার সময় এসেছে।”