মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- আসলে ‘গুন্ডা ট্যাক্স’, যার পোশাকী নাম পার্কিং ফি। পুলিশ, প্রশাসনকে বোকা বানিয়ে, জায়গায় জায়গায় হয় পুজো কমিটির মাথায় বেল ভেঙে, নয় পুজো কমিটির কাউকে কাউকে ভাগে নিয়ে, নয়তো বা ভেট দিয়ে, দুর্গাপুজোর সময় দুর্গাপুরের বিভিন্ন পাড়ায়, মহল্লায় এবছর কম করে দেড় কোটি টাকার নগদ ব্যবসা হলো শহরে। যে ব্যবসার জি এস টি, ডিউটি, বানিজ্য করের কোনো গল্পই নেই। আড়াই কোটি টাকার বেবাক লুঠ, আর চেয়ে চেয়ে দেখলো রাজ্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন ।
সদ্য সমাপ্ত দুর্গা উৎসবকে কেন্দ্র করে শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুর ও তার আশেপাশের এলাকায় এক মিলন মেলার রূপ নিয়েছিল। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা তথা ভিন রাজ্য থেকেও বরাবরের মতো এবারও বহু মানুষ এসেছিলেন দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের প্রতিমা দর্শন করতে। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বিশ্ব বাংলা শারদ সম্মান প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরের বেশ কয়েকটি নামী পুজো উদ্যোক্তারা সরকারি পুরস্কারও পেয়েছেন। শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরের মানুষজন এই নিয়ে অবশ্যই গর্বিত। একটি অসমর্থিত সূত্র মারফত জানা গেছে এবছর দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে পুজো প্যান্ডেল ঘুরতে বাইরে থেকে এসেছিলেন প্রায় ২৫(পঁচিশ) লক্ষ মানুষ। সহজেই অনুমান করা যায় এই বিশাল সংখ্যক মানুষজন শিল্পাঞ্চলের নামী পুজো প্যান্ডেল গুলি দর্শন করার জন্য বাইরে থেকে এসেছিলেন যানবাহনে করেই। সেই তারাই এবার এই পার্কিং ফি বা ‘গুন্ডা ট্যাক্স’র সমস্যার সম্মুখীনও হয়েছেন বলে অভিযোগ। শিল্পাঞ্চলের বিশ্ববাংলা শারদ সম্মান পাওয়ার বেশ কয়েকটি বড় পুজো উদ্যোক্তারা তাদের পূজো মন্ডপের অদূরে একটি করে দুই চাকা ও চারচাকা সাইকেল স্ট্যান্ড তৈরি করেছিলেন। সেই সব সাইকেল স্ট্যান্ড গুলির জন্য কোন বৈধ অনুমতি টেন্ডারের মাধ্যমে দুর্গাপুর মিউনিসিপাল কর্পোরেশন এবং দূর্গাপুর ইস্পাত কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি নিশ্চিৎ ভাবেই বলা যায়। শুধু তাই নয় ওইসব পার্কিং স্ট্যান্ড গুলিতে অবৈধভাবে পুরসভা ও ইস্পাত কর্তৃপক্ষের বসানো বৈদ্যুতিক বাতিস্তম্ভ থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে লাগাতার আলো জ্বালানো হয়েছিল উৎসবের দিনগুলিতে বলে অভিযোগ।
এবছর শারদ সম্মানে ভূষিত যে কটি পুজো উদ্যোক্তারা দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে রয়েছে তাদের প্রত্যেকটি পার্কিং স্ট্যান্ডেই দুই চাকার জন্য ২০ টাকা ও চার চাকার জন্য ৩০ টাকা ধার্য হয়েছিল পার্কিং ফি বাবদ। যদি ধরে নেওয়া হয় – এবছর শিল্পাঞ্চলে ২৫ লক্ষ মানুষ এসেছিলেন এই দুর্গাপূজো প্যান্ডেল গুলি দর্শন করতে, তাহলে, সহজেই অনুমান করা যায় যে প্রায় দু লক্ষ, দুই চাকা ও চারচাকা গাড়ী দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের ভেতরে এইসব পার্কিং গুলিতে ছিল পাঁচ দিনে। দুর্গোৎসবের সময় তাহলে এই বিপুল সংখ্যক টাকার কোন বৈধ হিসাব কেন দেখানো হচ্ছে না – এ নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয় কোথাও আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের জায়গায়, দুর্গাপুর মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের জায়গায় বা ইস্পাত কর্তৃপক্ষের জায়গাকে দখল করে অবৈধভাবে এই পার্কিং এরিয়া তৈরি করার অনুমতিইবা কে দিল ?
একটি অসমর্থিত সূত্র মারফত জানা গেছে এক একটি প্যান্ডেলের শুধুমাত্র এই অবৈধ পার্কিংয়ের থেকেই রোজদিন রোজকার হয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা করে। এইসব পার্কিংয়ের তোলা টাকা কি কোথাও সরকারিভাবে নথিভুক্ত হয়েছে বা যেসব সরকারি ও কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার জায়গা ব্যবহার করে ফাটকা ব্যবসা করা হয়েছে, তার লভ্যাংশ কি সেইসব সংস্থাকে ট্যাক্স বাবদ দেওয়া হয়েছে ?
দুর্গাপুর পুরণিগমের এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, “না। ওইসব প্যান্ডেলের পার্কিং থেকে আমাদের কোনরকম আয় হয়নি।” দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে প্রতিমা দর্শন করতে আসা জামুরিয়া এলাকার এক বাসিন্দা সমর ধীবর তার পরিবারকে নিয়ে এসে আক্ষেপের সুরে জানান, “দুর্গাপুরে ঠাকুর দেখতে এসে ৩০০ টাকা শুধুমাত্র দুই চাকার পার্কিং ফি দিতে হল। আসানসোল থেকে দুর্গাপুর ঠাকুর দেখতে আসতে মোটরসাইকেলে আমার ৩০০ টাকার তেল লাগেনি, কিন্তু প্রতিটি প্যান্ডেলে কিছু মত্ত, অশিক্ষিত, অভদ্র ছেলেদেরকে দাঁড় করিয়ে একপ্রকার ‘দাদাগিরি ট্যাক্স’ এর মতন করে পার্কিং আদায় করছে এইসব পুজো কমিটি।”
শহর দুর্গাপুরেরও একাধিক মানুষ এই পার্কিং ফি নিয়ে গর্জিয়ে উঠেছেন এবার। তাদের একটাই অভিযোগ, “বিশ্ব বাংলা শারদ সম্মান প্রদান কমিটি যারা পরিচালনা করেন, তারা কি চোখে ঠুলি পরে ছিলেন যে এমন সব পুজো উদ্যোক্তাদেরকে তারা পুরস্কৃত করছেন, যারা অবৈধভাবে সরকারি ও আধা সরকারী সংস্থার জায়গা দখল করে পার্কিংয়ের নামে ‘দাদাগিরি ট্যাক্স’ আদায় করছে ?” আগামী দিনে বিশ্ব বাংলা শারদ সম্মান নিয়ে প্রশ্নের চিহ্নের মুখে রয়েছে সেরা পুজো, সেরা মণ্ডপ, সেরা পরিবেশের পুজোগুলি। গণদাবী – শুধু লাখ লাখ টাকার প্যান্ডেল খাড়া করলেই চলেনা, দর্শনার্থীদের জন্য সুব্যবস্থা এবং এই পার্কিংয়ের স্থান, ফি যেনো উল্লেখ থাকে।