সঙ্গীতা চৌধুরী,হুগলিঃ- আজ আমি আপনাদের বলবো হুগলির আতড়ার ব্যানার্জী বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোর গল্প। এই পুজোর অতীত ইতিহাসে লুকিয়ে আছে এক মায়ের অপমান ও পাঁচ ভাইয়ের প্রতিজ্ঞার গল্প,আছে মায়ের দৈবাদেশের গল্প আর মায়ের অলৌকিক মহিমা!
হেমনলিনী দেবীর ছিলো পাঁচ সন্তান, বামাচরণ, সূর্যকান্ত, প্রসন্ন, হরিপদ, আশুতোষ। তারা লোকের জমিতে দিনমজুর খেটে, কাজ করে সংসার চালাতেন। তখন আতড়ায় অভয় মুখার্জীর বাড়িতেই একমাত্র ধুমধাম করে জগদ্ধাত্রী পুজো হতো আর সেই পুজোয় এই পাঁচ ভাই পরিবেশনের কাজে যেতেন। হেমনলিনী দেবী সেখানে যেতেন ভান্ডার রক্ষিকার কাজে। এর মধ্যে কোনো এক বছর পুজোয় এক সন্ন্যাসী আসেন, তিনি বাইরে প্রচুর লোককে মায়ের ভোগের প্রসাদ খেতে দেখে মনে মনে ভাবতে থাকেন যে, এত লোক খাচ্ছে আমি বোধহয় আর খাবার পাবো না, দেখি একবার ওই ভাঁড়ার ঘরের মাকে বলে!-এই ভেবে তিনি হেমনলিনী দেবীকেই বলেন, “মাগো, তুমি যদি এক মুঠো খেতে দাও, তাহলে আমি খেয়ে চলে যাই।”
হিমনলিনী দেবী তখন বলেন, “এটা তো বাবা আমার বাড়ির পুজো নয়। আমি কী করবো?” কিন্তু সন্ন্যাসী ঠাকুর হেমনলিনী দেবীকে বারংবার বলতে থাকেন, সন্ন্যাসীর অনুনয় শুনে হেমনলিনী দেবী আর না করতে পারেন না, একটা আসন পেতে তাকে খেতে দেন। এমন সময় বাড়ির কর্তা সেখানে এসে হাজির হযন এবং সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করেন, “এই তোমাকে কে এখানে খেতে দিয়েছে?” সন্ন্যাসী বলেন, “ওই মা খেতে দিয়েছে।” বাড়ির কর্তা তখন অবজ্ঞাসূচক গলায় বলেন, “পরের ধনে পোদ্দারি হচ্ছে! ওই মায়ের কী আছে? যে খেতে দেবে?” এই কথা হেমনলিনী দেবী ঘরের ভেতর থেকে শুনতে পান, তিনি তখন নীরবে কাঁদতে থাকেন, এমন সময় ছোট ছেলে আশুতোষ পরিবেশন করতে করতে ভাত ফুরিয়ে যাওয়ায় মায়ের কাছে ভাত নিতে আসে এবং মাকে কাঁদতে দেখে মায়ের কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করেন।
হেমনলিনী দেবী প্রথমে বলতে না চাইলেও পরে ছেলের জোরাজুরিতেই সবটা খুলে বলেন। আশুতোষের দেরী হচ্ছে দেখে বড় ভাই বামাচরণ আসেন এবং ছোট ভাই আশুতোষকে বলেন,“তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভাত নিয়ে আয়”। ছোট ভাই তখন বলে, “মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, পরিবেশন করবি কিনা?” বামাচরণ তখন মায়ের কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা শোনেন, ইতিমধ্যে বড় দাদা আর ছোটো ভাইয়ের দেরী দেখে বাকি তিন ভাইও সেখানে গিয়ে হাজির হয়। মায়ের অপমানের কথা শুনে তারা ঠিক করেন তারা আর এক মুহূর্ত এই বাড়িতে পরিবেশন করবে না, বাড়ির কর্তাকে তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, “যেখানে আমার মায়ের অপমান হয়েছে,সেখানে আমরা কেউ নেই আপনারা কী করবেন, বুঝে নিন।”
সেইদিন মুখার্জীদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পুজো মন্ডপে মায়ের সামনে মাথা খুঁড়ে পাঁচ ভাই তখন প্রতিজ্ঞা করেন,“মা তোর পুজো যদি আমরা কোনদিন করতে পারি, সেদিন থালা ধরবো তার আগে নয়।”-এরপরের বছর দুর্গাপুজোর দশমীর ঠিক আগেই বামাচরণ স্বপ্নাদেশ পান, মা তাকে বলছেন,“ বলেছিলি আমার পুজো করবি, কর।” বামাচরণ তখন জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কে মা ?” মা তখন বলেন,“ আমি জগদ্ধাত্রী, আমার পুজো করতে গেলে দশমীতে মাটি তুলতে হয়।”
সেই স্বপ্নাদেশে মা বলেছিলেন যে, মুখার্জীবাড়ির পুজো উঠে যাবে। একই সাথে মা বামাচরণকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, মায়ের কেমন মূর্তি হবে আর পুজোর কী কী নিয়ম। বামাচরণ মাকে বলেছিলেন পুজো করার মতো বাসনপত্র তার কাছে নেই। মা তখন নিজেই বলে দেন, “কলকাতায় হরিপদ মুখার্জির বাড়ি যাবি, ওদের পুজো বন্ধ হয়ে গেছে, ওদের কাছে গিয়ে বলবি মা আমাদের বাড়ি আসছেন,পুজোর বাসন গুলো দিন। আর তিনটি পাঠা আমাকে দিবি।”
এরপর মায়ের স্বপ্নাদেশের কথা বামাচরণ তার অনান্য ভাই ও মাকে বলে। সব শুনে হেমনলিনী দেবী বলেন,“মা যখন পুজো চেয়েছে,যে করেই হোক পুজো করতে হবে।” মায়ের দৈবাদেশ অনুযায়ী এরপর প্রসন্ন কলকাতার বেহালায় যায় বাসন নিতে আর বামাচরণ পুজোর অন্যান্য সমস্ত কিছু জোগাড় করতে থাকেন। তবে সব থেকে অলৌকিক ঘটনা হলো, বলির তিনটে পাঁঠার মধ্যে একটি পাঁঠা প্রথম বছর পুজোয় নিজে নিজেই হাজির হয়েছিল ব্যানার্জীদের বাড়িতে, সেই পাঁঠার মাথায় সিঁদুরও দেওয়া ছিলো। কিন্তু সে পাঁঠা কোথা থেকে এসেছিলো তা কেউ জানে না। পরবর্তীতে পাঠার খোঁজ নিতেও কেউ আসে নি।! সবাই মনে করেন, মায়ের বলির পাঁঠা মা ই পাঠিয়েছেন। তবে মায়ের অলৌকিক গাঁথা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরো গল্প আছে, সে সব না হয় অন্য কোনো দিন বলবো।
পাঁচ ভাই মিলে সেই যে পুজো শুরু করে ছিলো, সেই পুজো আজ ২৭১ তম বর্ষে পা দিয়েছে। জগদ্ধাত্রী পুজো অন্যান্য জায়গায় সপ্তমী থেকে শুরু হলেও এখানে নবমী দশমী এই দুই দিনই মায়ের পুজো হয় ঘরোয়া পুজোর আমেজ পেতে গেলে আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে আতড়ার ব্যানার্জী বাড়িতে।
উল্লেখ্য, ব্যানার্জী বাড়ির বর্তমান পুরোহিত ও চতুর্থ প্রজন্মের বড় ছেলে অক্ষয় কুমার ব্যানার্জীর থেকেই মায়ের অলৌকিক মহিমার গাথা শোনা।