জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,আউসগ্রামঃ- ভ্রমণপিপাসু মানুষকে কখনো টানে সমুদ্র, কখনো বা পাহাড়। কেউ ছুটে যায় তীর্থস্থানে, কেউবা মন্দির শহরে। কেউ কেউ বনের দৃশ্য ক্যমেরাবন্দী করার জন্য ছুটে বেড়ায় বনে বনে। ভ্রমণের টানে ভ্রমণপিপাসু বাঙালি ছুটে যায় দেশ থেকে দেশান্তরে। কিন্তু বাড়ির পাশেই একরাশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে বসে আছে অরণ্য সুন্দরী আউসগ্রাম সেই খবর অনেকেই রাখেনা। আসলে সেভাবে প্রচারের আলোয় আনা হয়নি এলাকাটিকে। তাই হয়তো অচেনা থেকে গেছে।
আউসগ্রামের সুন্দরী জঙ্গলমহলের ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে রাস্তা- কোথাও ঢালাই কোথাও বা লাল মোড়াম। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি গাছ। গাছে নানা রকম পাখির কিচিরমিচির শব্দ। শুনলেই মন ভরে যায়। এখন আবার আদুরিয়া সহ বিভিন্ন জঙ্গলে ময়ূরেরও দেখা মেলে। সব মিলিয়ে অরণ্যের নীরব পরিবেশে এক অপার আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য নিয়ে অবস্থান করছে এই এলাকা। এর কোনো শেষ নাই। সৌন্দর্যের টানে শুধু জঙ্গল প্রেমীরা নয় সাধারণ মানুষও ছুটে আসে। শীতের সময় তো তাদের আগমন বেড়ে যায়- কেউ আসে পিকনিক করতে, কেউবা সৌন্দর্যের টানে। মুহূর্তের মধ্যে ক্যমেরাবন্দী করে ফেলে সৌন্দর্যকে।
দীগনগরে আছে বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্রের তৈরি বিখ্যাত জলটুঙ্গি বা হাওয়া মহলে। বিশাল দিঘীর মাঝে একটা ছোট্ট বাড়ি, চারপাশে জল। তার সৌন্দর্য যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করবেই।
সেখান থেকে একটু এগিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে প্রায় ৭২ বিঘা জমির উপর গড়ে ওঠা উজান পার্ক। গাছের ছায়ায় ঘেরা পার্কের ভিতর বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের জন্য যেমন ব্যবস্থা আছে তেমনি বড়দের জন্যেও আনন্দের উপকরণ আছে। পাশের জঙ্গল তো পিকনিকের জন্য আদর্শ জায়গা।
বনের মধ্যে ভাল্কী-মাচানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি পিকনিক স্পট। শীতের সময় দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ এখানে পিকনিক করতে ছুটে আসে।
কাছেই রয়েছে বিখ্যাত ‘আলপনা’ গ্রাম লবণধার। চারপাশে জঙ্গল এবং তার মাঝে অবস্থিত এই গ্রাম। পেশাদার শিল্পীর তুলির টানে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন নকশা। মনসা মন্দিরে আছে সাপের চিত্র, কোথাও আছে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। পশুপাখি, মাছ ইত্যাদি তো আছেই। অরণ্যের মধ্যে বাইরের জগতের কিছুটা আড়ালে নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে অবস্থান করছে গ্রামটি।
সুটিং স্পট হিসাবে ধীরে ধীরে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে কালিকাপুরের রাজবাড়ি। অমিতাভ বচ্চন, প্রসেনজিৎ, দিতিপ্রিয়া সহ একাধিক জনপ্রিয় তারকারা যখন এখানে সুটিং করে গেছেন তখন জায়গাটির গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু থাকতে পারেনা।
কয়েক কিলোমিটার দূরে রয়েছে ইছাই ঘোষের দেউল পার্ক। বর্তমানে এলাকাটি পিকনিক স্পট হিসাবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। শীতের সময় ভিড় লেগেই থাকে।
বর্ধমান, দুর্গাপুর বা বোলপুর থেকে মাত্র কয়েক কিমি: দূরে অবস্থিত জায়গাটিতে সড়কপথ বা রেলপথ ধরে সহজেই আসা যায়। পূর্বরেলের গুসকরা বা মানকর স্টেশন থেকে মাত্র কয়েক কিমি: দূরে অবস্থিত জায়গাগুলো। ব্যক্তিগত গাড়িতে এলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে বা এনএইচ -২ বি ধরে সহজেই সমস্ত জায়গায় যাওয়া যায়। সমস্যা একটাই রাত্রিবাস করার মত কোনো রিসর্ট গড়ে ওঠেনি। ফলে সব থাকতেও কিছু একটার ঘাটতি দেখা যায়।
ট্যুরিজমকে কেন্দ্র করে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। ফলে বদলে যেতে পারে এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। তেমনি এর থেকে সরকারের রাজস্ব প্রাপ্তি ঘটে বিপুল। ফলে গত কয়েক বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার ট্যুরিজমের উপর প্রচুর গুরুত্ব দিয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সম্ভাব্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোর পরিকাঠামো উন্নয়নে যথেষ্ট নজর দেওয়া হচ্ছে। পর্যটকদের জন্য বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠছে হোটেল, রিসর্ট ও রেস্টুরেন্ট। উদাহরণস্বরূপ গত চার-পাঁচ বছর ধরে বীরভূমের তারাপীঠের তো আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। স্থানীয় প্রশাসন সক্রিয় হলে এখানেও সেই ধরনের সম্ভাবনা প্রচুর। হয়তো সেক্ষেত্রে গুসকরা বা মানকরে হোটেল শিল্প বিস্তার লাভ করতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দা তুহিন কোনার বললেন- পর্যটকদের থাকার জন্য এখানে পড়ে থাকা ফাঁকা জায়গায় যদি কোনো রিসর্ট বা সরকারি আবাসন গড়ে তোলা হয় তাহলে এলাকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যাবে। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা কখনোই জঙ্গলের মূল চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে চাননা।
কথা হচ্ছিল আউসগ্রাম-২ নং ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মমতা বারুইয়ের সঙ্গে। তিনি বললেন – আমাদের লক্ষ্য রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে এলাকাটির নাম তুলে আনা। ইতিমধ্যে আমরা বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা শুরু করেছি। আশাকরি খুব শীঘ্রই ভ্রমণপিপাসু মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যাবে এলাকাটির নাম। হয়তো তখন শান্তিনিকেতন যাওয়া-আসার পথে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে।
স্হানীয় বিধায়ক অভেদানন্দ থাণ্ডার বললেন – পর্যটন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে শীঘ্রই এলাকাটিকে কেন্দ্র করে একটা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। তার আশা খুব শীঘ্রই ভ্রমণপিপাসু মানুষের ইচ্ছে পূরণ হবে।