eaibanglai
Homeএই বাংলায়অ্যামেচার যাত্রা জগতের বিশিষ্ট অভিনেতা কাঁকসার সোমেশ মুখার্জ্জী

অ্যামেচার যাত্রা জগতের বিশিষ্ট অভিনেতা কাঁকসার সোমেশ মুখার্জ্জী

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী:- গ্রামের দুর্গাপুজোর নবমীর রাত। সন্ধ্যা হতে না হতেই দর্শক আসতে শুরু করেছে, গ্রামে যেমন হয়। প্যাণ্ডেল কানায় কানায় ভরে গেছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দর্শক ধৈর্য্যহারা হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ ফাঁকা মঞ্চে ঢিল ছুড়ছে। ওদিকে কার্যত সন্ধ্যা থেকেই মাইকে তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে ঘোষক- বন্ধুগণ, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে আমাদের আজকের অশ্রুসজল সামাজিক যাত্রাপালা ‘রাধার নিয়তি’। আপনারা একটু ধৈর্য্য ধরে বসুন।

ঢং ঢং করে যাত্রা শুরুর ঘণ্টা বেজে উঠল। মঞ্চে হাজির যন্ত্র বাদকরা। শুরু হলো বহু প্রতীক্ষিত কাঁকসার খাঁটপুকুর ‘যুবনাট্য’ সংস্থা পরিবেশিত যাত্রাপালা ‘রাধার নিয়তি’। নিজ গতিতে এগিয়ে চলেছে যাত্রাপালা। প্রায় এক ঘণ্টার মাথায়- ‘এই আমাদের রাতের সংসার। নতুন নতুন নাগর! কি সুন্দর সম্ভাষণ আমরা বারবিলাসিনী’ সংলাপ বলতে বলতে মঞ্চে প্রবেশ করলেন এক মহিলা শিল্পী। সেই শুরু। এসব প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৪ সালের ঘটনা। সেদিনের সেই মহিলা চরিত্রের অভিনেতা ছিলেন বর্তমানে কাঁকসা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সুপরিচিত যাত্রা শিল্পী সোমেশ মুখার্জ্জী- ছোটবড় সবার প্রিয় লালুদা।

পরবর্তীকালে প্রায় একশ’র কাছাকাছি যাত্রা পালায় বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সামাজিক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক – প্রায় সমস্ত ধরনের যাত্রাপালায় দর্শক তাকে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখেছেন এবং মুগ্ধ হয়েছেন। শুধু মহিলা চরিত্রে নয় অভিনয়ের ক্ষেত্রে হিরো, ভিলেন, কমেডি সহ সমস্ত ধরনের চরিত্রে তিনি ছিলেন সাবলীল।

আজও এলাকার প্রবীণদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘অভিশপ্ত ফুলসজ্জা’ পালায় ‘মণি’, ‘হাসির হাটে কান্না’ পালায় ‘অতনু’, ‘রাধার নিয়তি’-তে ‘স্বরূপ’, ‘বেগম আসমান তারা’-তে ‘যদুনারায়ণ’, ‘ক্ষুদিত হারেম’এ’আলাউদ্দিনখলজি’,’তাজমহল’এ’ঔরঙ্গজেব’,’গণদেবতা’-তে ‘চিরু’, ‘রক্তে রোয়া ধান’-এ ‘মি.চাবুক’, ‘শ্রী চরণেষু মা’-তে ‘পাগলা বাবু’, ‘নর নারায়ণ’-এ ‘কৃষ্ণ’, ‘মা মাটি মানুষ’-এ ৪ টি চরিত্র, ‘ভিখারী ইশ্বর’- এ ‘ইশ্বর’ সহ অসংখ্য চরিত্রে তাকে রূপদান করতে দেখা গেছে।

অভিনয় জগতে তার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় যখন তিনি ‘নটি বিনোদনী’ পালায় ‘রামকৃষ্ণ’-এর চরিত্রে অভিনয় করেন। আজও সেই পালার কথা মনে পড়লে শিউরে ওঠেন সোমেশ বাবু। তার ভাষায় – আজও মনে পড়ে সেই দিনের কথা যখন নির্দেশক আমাকে ‘নটি বিনোদনী’ পালায় রামকৃষ্ণের চরিত্রে অভিনয়ের কথা বলেন। মনের মধ্যে ভয় ছিল – পারব তো! অবশেষে সব দ্বিধা কাটিয়ে যখন পালাটি মঞ্চস্থ হলো মনে পড়ে দর্শকদের হাততালির কথা। বেশ কয়েকটি জায়গায় এই পালায় অভিনয় করেছি।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অভিনয় জীবনে তিনি বহু মানুষের আশীর্বাদ ও ভালবাসা পেয়েছেন। কপালে জুটেছে বহু পুরস্কার। কিন্তু যাত্রা জগত থেকে যখন তিনি কার্যত দূরে সরে গেছেন ঠিক তখনই পেলেন অনন্য আর এক সম্মান। অ্যামেচার যাত্রা জগতে অসামান্য অবদানের জন্য কয়েকদিন আগে পশ্চিম বর্ধমান জেলার তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর থেকে তাকে সম্মানিত করা হয়। কাঁকসা ব্লকের বিডিও তার হাতে তুলে দেন একটি মানপত্র। এলাকার তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এই সম্মান পেলেন। মলানদীঘির তরুণ শিল্পী কৃষাণু ব্যানার্জ্জী বললেন – সঠিক মনোনয়ন। যোগ্য ব্যক্তির হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা গর্বিত।

অভিনয় জগতে বিভিন্ন নাট্য ব্যক্তিত্বের তিনি পরামর্শ পেয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রয়াত দীপক আচার্য, ধীরেন মণ্ডল, বন্ধু সনৎ মণ্ডল, শান্তি মণ্ডল, দুর্গা শংকর মণ্ডল প্রমুখ। অসংখ্য পালায় অভিনয় করলেও যাত্রা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের অনাগ্রহ সোমেশ বাবুকে হতাশ করে। তার বক্তব্য – আমরা যখন অভিনয় করতাম তখন প্রথম দিকে মঞ্চ হতোনা। একটা জায়গা দড়ি দিয়ে ঘিরে মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করা হতো। হ্যাচাকের আলোয় অভিনয় করতে হতো। মাইকও ছিলনা। পরে যখন এগুলোর সাথে পরিচিতি ঘটে সময়ের সাথে সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়েছে, নিজের অভিনয় স্টাইলের পরিবর্তন আনতে হয়েছে। আরও অনেক কিছুর অভাব থাকলেও আমাদের আন্তরিকতার অভাব ছিলনা। আজ সব আছে, বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সেই আগ্রহ বা আন্তরিকতা নাই। হয়তো শেষ পর্যন্ত অ্যামেচার যাত্রা বন্ধ হয়ে যাবে।

অথচ অ‍্যামেচার যাত্রার হাত ধরে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বিভিন্ন সময়ে এই অ‍্যামেচার দলগুলো চিৎপুরের পেশাদার দলগুলোর জন্য শিল্পী সরবরাহ করে থাকে। এক কথায় অ‍্যামেচার দলগুলো হলো যাত্রা শিল্পের ‘লাইফ লাইন’। কিন্তু বাংলার এই প্রাচীন সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখে। গ্রামের বিভিন্ন উৎসবে আজ আর সেভাবে যাত্রা হয়না।

অ‍্যামেচার যাত্রা জগতের এক শিল্পী তথা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রাণীগঞ্জের রাজা চৌধুরী বললেন – সেভাবে লালুদার অভিনয় দেখা হয়নি। যেটুকু দেখেছি বা প্রবীণদের কাছে শুনেছি তাতে বলতে পারি উনি একজন বিরল প্রতিভাবান মানুষ। অভিনয় তার সহজাত। এযুগের অন্যতম জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ পালাকার ব্রহ্মময় চট্টোপাধ্যায় বললেন- লালুদা আমার থেকে যথেষ্ট সিনিয়র। এখনো উনার শেখার আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করে।

যাত্রা জগত থেকে কিছুদিন হলো সরে এসেছেন সোমেশ বাবু। অবসর সময়ে ড্রয়িং রুমে বসে অভিনয় জীবনের প্রাপ্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং স্মৃতিচারণ করতে থাকেন – সেই দর্শক, মঞ্চ, অভিনয় হাততালি। নিজেকে বারবার হারিয়ে ফেলেন। ভাবতে থাকেন – বর্তমান প্রজন্ম যদি একটু উৎসাহি হয় তাহলে আবার হয়তো —- কথা বলতে বলতে প্রবীণ অভিনেতার চোখের কোণ দিয়ে দু’ফোটা মুক্ত ঝরে পড়ল।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments