জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, হুগলি:- আর্থিক সমস্যা, সামাজিক জটিলতা এবং সর্বোপরি তরুণ সমাজের অনীহার কারণে নাটক নামক বিনোদনের মাধ্যমটির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। তারপরও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে একদল নাট্যপাগল মানুষের সৌজন্যে আজও নাট্যপ্রেমী মানুষ নাটকের স্বাদ উপভোগ করার সুযোগ পান। সম্প্রতি হুগলির হরিপালের ‘উদয়তীর্থ নাট্যদল’-এর সৌজন্যে সেই সুযোগ পেল স্থানীয় কয়েকশ’ নাট্যপ্রেমী মানুষ। তাদের উপস্থিতিতে মোশাইমোড় উদয়তীর্থ মঞ্চে মঞ্চস্থ হলো বিখ্যাত নাট্যকার মনোজ মিত্র রচিত নাটক ‘নরক গুলজার’।
নাট্যশিল্পের মর্যাদা পুরোপুরি বজায় রেখে যে কয়েকজন নাট্যকার অনায়াস দক্ষতায় বাংলা নাটকে সরাসরি শোষিত মানুষের পক্ষ নিয়ে শোষক শ্রেণির মুখোশ ছেঁড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তাদের অন্যতম হলেন মনোজ মিত্র। তাঁর একাধিক নাটকে এই প্রবণতা বারবার দেখা গেছে। কখনো সিরিয়াসভাবে, কখনো বা দেবতা ও ভূতের আধিপত্যে হাসি, মজা, হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গিতে নিজের দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তাইতো সত্তর দশকে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপটি ধরা পড়েছে ‘নরক গুলজার’ নাটকে। দেব-দেবী, স্বর্গ-মত্যের কাহিনির মধ্যে দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন সমকালীন সমাজের অস্থিরতাকে।
সাধারণত প্রচুর খারাপ লোকের একত্র সমাবেশের জমাট আসরকে নরক গুলজার বলা হয়। উত্তেজিত ঘোডুইয়ের হঠাৎ মৃত্যু, তার মৃতদেহ ঘিরে নরকের ভয়াবহ ডাকিনী পিশাচদের পৈশাচিক উল্লাস, ‘বলহরি হরিবোল ধ্বনি’ মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশকে নরক গুলজার করে তোলে। দুই অঙ্ক ও দশটি দৃশ্য বিশিষ্ট নাটকটিতে তেরোটি চরিত্র আছে। প্রতিটি চরিত্র বর্তমান সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে গেছে। কেউ রাষ্ট্রশক্তির প্রতিনিধি, কেউ তাঁবেদার, কেউবা ভণ্ড। সবার উপরে আছে ‘দু’কাঠির মাদল’ নারদ। দর্শক চরিত্রগুলোর মধ্যে বাস্তবের মিল খুঁজে পাবেই।
নাটকের প্রথম সংলাপ – ‘মানকো এই শালা মানকো এতবড়ো সাহস তোর, তুই আমার গাছে হাত দিসা একগাছ তেঁতুল আমার রাতারাতি ফরসা!’- শোষিতের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব স্পষ্ট করে দেয়। রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক ব্রহ্মার উৎকোচ গ্রহণ করার দৃশ্য দেখে বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে দর্শক মিল খুঁজে পায়।
শেষ দৃশ্যে ব্রহ্মা যখন বলেন -‘… নচ্ছার পাজি বর্ণচোরা ফ্রাংকেনস্টাইন লিখলি কিনা স্বর্গ নরকে সবারই গো-জন্ম।….. আমারই সই, আমারই ব্ল্যাংক পেপার-এ সই যে আমারই মুখের জিয়োগ্রাফি এমনি পালটে দেবে কে জানত…. একটা রিকোয়েস্ট গোরুর মধ্যেও আমাদের একটু স্পেশাল ট্রিটমেন্ট কোরো …’ চেনা দৃশ্য। ব্রহ্মার মুখোশ টেনে মুখ ঢেকে চলার মধ্যেও দর্শক মিল খুঁজে পাবে।
নারদ থাকা মানেই গান থাকবেই। ‘ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন’- রাষ্ট্র নায়কদের প্রতি নিদারুণ ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে। নাট্যকারের বিমূর্ত ভাবনা তখনই মূর্ত হয়ে ওঠে যখন নাটকের চরিত্ররা সেগুলির বাস্তব রূপ দিতে সমর্থ হয়। এখানেই কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন তারাশঙ্কর ব্যানার্জ্জী, বিজন চ্যাটার্জী, অন্বয় দে সহ প্রতিটি শিল্পী অসাধারণ দক্ষতায় নাট্যকারের ভাবনা দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন। সুভাষ কর্মকারের অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করলেও পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ত্রুটি চোখে পড়ে। দলের দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অমল ব্যানার্জ্জী ও অজিত দাস এই নাটকে অভিনয় করেন।
আলো-আঁধারি পরিবেশে ভুতুড়ে আবহ-সঙ্গীত ও পিশাচরূপী স্পন্দিতা দে, তুয়া আদক, মিতালী দে, রণিত চক্রবর্তী ও প্রতিম কর্মকারের ভুতুড়ে নৃত্য দর্শকদের শিহরিত করে তোলে। এরা প্রত্যেকেই ‘তাইকান্ডো অ্যাকাডেমি অব হরিপাল’-এর শিশুশিল্পী। এক্ষেত্রে অন্বয় দের অসাধারণ কোরিওগ্রাফি প্রশংসনীয়। নাটকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মঞ্চসজ্জা। নাটকের প্রয়োজনে মঞ্চসজ্জা এবং শব্দ ও আলো প্রক্ষেপণ ছিল যথাযথ।
প্রসঙ্গত নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও উদয়তীর্থ নাট্যদল গত ৬০ বছর ধরে এলাকার মানুষের মানুষের মনোরঞ্জন করে চলেছে। নাট্যদলের নিজস্ব মঞ্চ ও মাঠ থাকা সত্ত্বেও আজও কোনো সরকারি সাহায্য তারা পায়নি। একটু সরকারি সাহায্য দলটিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সরকার কি এই দলটির দিকে একটু নজর দেবে? সময় বলবে।