মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর: কবি বসলেন কুরশিতে। আড্ডা’য় শুরু হল নতুন দিন। নতুন সাংসদ, নতুন চেয়ারম্যান, নতুন করে ফিরে পাওয়া পুরনো এক বন্ধুকে পাশে বসিয়ে বুধবার শুরু হল কবি দত্তের নতুন আড্ডা। ঠিক তখনই তার পাশ থেকে উড়ে এলো ‘দুর্গাপুরের জয়’ ধ্বনির ইষৎ উল্লাস!
ঠিক ২৩ মাস আগে আচমকা পাওয়া ‘আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা’র ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে আসানসোলের তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়কে হঠিয়ে চেয়ারম্যানের পদে বসতে দুর্গাপুরের এই কবি’র সময় লাগলো শুধু ওইটুকুই। তার ক্যারিশমাতেই যাকে বলে ঝড়ে উড়ে গেলেন আসানসোলের বর্ষীয়ান তাপস। আর এডিডিএ তে শেষ হলো আসানসোলের রাজ। কবি যখন কুরশীতে, তখন এই হোটেল ব্যবসায়ীর উত্তরণের এই সোপান গড়ার অন্যতম কারিগর রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার এদিন মিটিমিটি হাসছিলেন দুধ সাদা ধুতি পাঞ্জাবি গায়ে। বললেন, “কবি বহু বছর ধরেই উদ্যোগের দুনিয়ার লোক। আমি নিজেও ওই দুনিয়া থেকে রাজনীতির জগতে এসেছি। লোকে বলে, মানুষের কল্যাণে আমার পূর্বতন অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্বাচ্ছন্দে কাজ করতে পারছি। আমার বিশ্বাস কবিও তার উদ্যোগের অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে দুর্গাপুরের উন্নয়নের কাজ করে যাবেন।” কবি কিন্তু চেয়ারে বসেই এদিনও সাফ জানিয়ে দিলেন, “আমি কিন্তু আজকেও রাজনীতির লোক নই।”
বহু কাঙ্ক্ষিত তার নতুন চেয়ারে বসে কবি বললেন, “আমি ঠিক কি কি করতে হবে, কোনটা কখন করতে হবে, তা প্রায়োরিটি সেক্টরে ভাগ করে এডিডিএকে এগিয়ে নিয়ে যাব।”
শহরে প্রশাসনিক বৈঠকে এসে দুর্গাপুরের হোটেল ব্যবসায়ী কবি দত্তকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় আচমকাই আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এ ডি ডি এ)র ভাইস চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা করে দেন। কবি সিটি সেন্টারে এডিডিএ ‘ র মুখ্য প্রশাসনিক ভবনে তার ওই পদে বসেন ১৬ জুলাই ২০২২ সকাল সকাল। তাকে ওই পদে বসানোয় মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি ছিল, দুর্গাপুরের উন্নয়নের গতি আনতে এ ডি ডি এ ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ দুর্গাপুরের জন্য আসানসোলের তাপস ঠিকঠাক ভাবছেন না। সময় দিচ্ছেন না। তাই, তিনি বেছে নিয়েছিলেন তার চেনাজানা ডাকসাইটে ওই হোটেল ব্যবসায়ীকেই। শহরের সিটি সেন্টারের তার বিলাসবহুল হোটেলটিতে প্রতি নির্বাচনের প্রচারে এসেই ওঠেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই হোটেলের মালিক কবি দত্তের সাথে তার আলাপ হয় ২০১১’র বিধানসভা নির্বাচনের সময় দলের হয়ে প্রচারে এসে। তারপর থেকে রুটিন মাফিক সেখানে তার রাত্রিযাপন। এবারও লোকসভা ভোটের প্রচারে এসে তিন দফায় মোট ১৪ দিন কবি দত্তের হোটেলেই টানা থেকে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কবির সিটি সেন্টারের পড়ে থাকা বাড়িটায় প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই টানা ৩ মাস স্বপরিবারে আশ্রয় কীর্তি আজাদের। অর্থাৎ, দুর্গাপুরে বাইরে থেকে আসা ভিআইপিদের রাতবিরেতের মাথার ছাদ বরাবর জুটিয়ে আসছেন এই কবি দত্তই।
কবিকে গোটা শহর যে নামে ডাকে সেই বাপ্পা নামেই সরকারি সভাতেও ডাকেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বাপ্পা’ই এবার হলেন এডিডিএ’র চেয়ারম্যান। কিন্তু, ভাইস চেয়ারম্যানের পদে বসেও মুখ্যমন্ত্রীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের জোয়ার আনতে কেন পারলেন না বাপ্পা? কবি নিজেও কিন্তু ভাইস চেয়ারম্যান পদে বসে মন:কষ্টে ছিলেন। বারবার ঘনিষ্ঠ জনের কাছে আফসোস করেছেন, তাকে ঠিকমতো কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে। তার অস্বস্তির ওই চেয়ারে আদতে এডিডিএ তে তার কপালে কেবল নাকি আসলে অনাদরই জুটেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, চেয়ারম্যান তাপসের সাথে তার বনিবনা তো হচ্ছিলই না, যা আরো খারাপ দিকে গড়ায় এডিডিএ তে কুখ্যাত অগ্নিকাণ্ডের পর। তার দপ্তরে আগুন লাগার পর ব্যবসার কাজে শিলিগুড়িতে যাওয়া কবি দুর্গাপুরে না এসে সটান পৌঁছে যান রাজ্যের নগর উন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের কাছে। এনিয়েও প্রকাশ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করেন তাপস। কবি চেয়ারম্যানের আসনে বসার পর তাকে তাপস অভিনন্দন জানিয়েছেন কিনা জানা যায়নি, তবে, নিজের অপসারণের পর তাপসের ছিল সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া – “যা হয়েছে, ভালো হয়েছে। আমার কোনো অসুবিধা নেই।”
তাপস না এলেও, বুধবার সদর দপ্তরে আসেন সংস্হায় ফের ভাইস চেয়ারম্যানের পদে বসা উজ্জ্বল চ্যাটার্জি। আসানসোলের কুলটির প্রাক্তন বিধায়ক এই উজ্জল কবির আগেও ছিলেন ওই পদে। এদিন কবি মন্ত্রী, সাংসদের সামনেই বার বার বলেন, ‘ওসব ভাইস টাইস বুঝিনা। আসানসোল কিন্তু তুমিই সামলাবে। ওখানে তুমিই চেয়ারম্যান।’ উজ্জল শুধু হেসে সামনে থেকে সরে যান।
বাম আমল থেকে এযাবৎ কাল অব্দি এডিডিএ’র চেয়ারম্যান পদে বরাবর বসেছেন রাণীগঞ্জ, বর্ধমান, আসানসোলের থেকে দুর্গাপুর শাসন করতে আসা লোকজন। কবিই প্রথম দুর্গাপূর্বাসী যিনি বসলেন মহার্ঘ্য ওই চেয়ারে। সম্ভবত তাই এদিন ধ্বনি উঠল – ‘ ‘দুর্গাপুরের জয়’! সেখানেই ভিড়ের বাইরে একেকজন বললেন, “উনি আসায় আশাকরি তিনি ব্যক্তিগত বিষয়ে নয়, শহরের সার্বিক উন্নয়নে নজর দেবেন।”
এদিন কবির অভিষেকে বিধাননগর থেকে ছুটে আসেন সদ্য সিপিএম থেকে কবির সৌজন্যে তৃণমুল কংগ্রেসে যোগ দেওয়া তার বন্ধু পঙ্কজ রায় সরকার। মন্ত্রী, সাংসদ আর কবির সাথে এক ফ্রেমে ফোটো তুলে সামনে থেকে তিনি অবশ্য সরে যান। পঙ্কজের মত সিপিএমের লড়াকু মুখকে টিএমসি তে এনে দেওয়ার উপহারই নাকি কবির এই নতুন পদে বসার নেপথ্যে আসল রহস্য, বলে গুঞ্জন ঘাসফুল শিবিরের আনাচে কানাচে।