জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- আবার একটা ‘অমর’ ২১ শে জুলাই। এটা নিছকই একটা ক্যালেণ্ডারের তারিখ নয়, তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে এই দিনটার গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যময়। মমতা ব্যানার্জ্জীর রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ‘টার্নিং পয়েন্ট’। দিনটি সফল করার জন্য তৃণমূলের সর্ব স্তরের নেতা-কর্মীরা নিজ নিজ এলাকায় জোরদার প্রচারে নেমে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ দলীয় কর্মীদের সামনে বক্তব্য রাখবেন দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জ্জী। দলকে নতুন দিশা দেখাবেন।
এবছর আবার দিনটির গুরুত্ব একটু অন্যরকম। তদন্তের নামে অভিষেককে বারবার কেন্দ্রীয় এজেন্সির তলব, লোকসভা নির্বাচনের মুখে কয়েকজন তৃণমূল নেতাকে তলব করা যাদের উপর নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব ছিল। এছাড়াও ছিল অন্যদের তলবের আশঙ্কা। সবমিলিয়ে একটা গেল গেল ভাব।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এইরাজ্যে ৩৫ টি আসনের লক্ষ্যমাত্রা সামনে রাখে। লক্ষ্য পূরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রী এবং একঝাঁক মুখ্যমন্ত্রী প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রমাণহীন কুৎসা ছিল তাদের প্রচারের প্রধান বিষয়বস্তু। নির্বাচনের মুখে সন্দেশখালির সন্দেশ তৃণমূলকে যথেষ্ট চাপে ফেলে দেয়।
পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আজও জনমানসে তৃণমূল সম্পর্কে একটা চাপা ক্ষোভ থেকে গেছে। একশ্রেণি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কাটমানি ও তোলাবাজি, আবাস যোজনা ও একশ দিনের কাজ সংক্রান্ত দুর্নীতি, বেআইনি বালি ও পাথর খাদান, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জঙ্গলের গাছ কেটে নেওয়া, সরকারি জায়গা দখল করে নেওয়া সহ বিভিন্ন অভিযোগ তো আছেই। ওদিকে ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’- র মত লোকসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের জোট। সবমিলিয়ে যথেষ্ট চাপে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস।
তারপরও রাজ্যের মানুষ মমতার উপর ভরসা রাখে। সব প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করে তৃণমূল কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে ২৯ টা আসন লাভ করে। ১২ টি আসন পেয়ে বিজিপিকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বিধানসভা ভোটের মত সিপিএম শূন্য থেকে যায়। রাজনীতির বর্ণময় চরিত্র অধীর চৌধুরী পরাস্ত। কেন্দ্রে সরকার গঠন করলেও বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুসরণ করে সম্প্রতি ৭ টি রাজ্যে অনুষ্ঠিত ১৩ টি বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপি মাত্র ২ টি আসন লাভ করে। এইরাজ্যে ৪ টি আসনেই তারা হেরে যায়। যতই শুভেন্দুরা ভোট লুঠ হয়েছে বলে চিৎকার করুক বিজেপির নীচু তলার কর্মীরা তাদের কথা বিশ্বাস করে বলে মনে হয়না।
তৃণমূলে দলের মধ্যেও আছে অনেক সমস্যা। কয়েকজন ব্লক ও অঞ্চল সভাপতি, দলীয় পদাধিকারী, পঞ্চায়েত প্রধান এবং বিধায়ক দলের মধ্যে নিজেদের অপরিহার্য মনে করে নিজ নিজ এলাকায় নিজেদের ‘বেতাজ বাদশাহ’ ভাবতে শুরু করে দেয়। এদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ক্ষমতার দালাল চক্র। লাভের পরিবর্তে দলের ক্ষতি হচ্ছে সেটা এলাকায় কান পাতলেই স্পষ্ট হবে। লুকিয়ে এঁদো পুকুরের জল খাওয়া গেলেও চুলকানি যেমন লুকিয়ে রাখা যায়না তেমনি স্মার্ট ফোনের দৌলতে বহু ঘটনা সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।
কোথাও দেখা যাচ্ছে ক্যামেরার সামনে তরুণী বা যুবককে বেপরোয়াভাবে মারধর করা হচ্ছে, ‘মব লিঞ্চিং’। প্রোমোটারের কাছে অর্থ দাবি করা হচ্ছে। অস্বীকার করলেই কপালে জুটছে মার। মেদনীপুরের একটি জায়গায় নাকি দলের কয়েকজন মাতব্বর নাকি শেষ কথা। কথা বলার সময় দলের কয়েকজন মন্ত্রীকে অবশ্যই সংযত হতে হবে। এরকম অজস্র ঘটনা গত কয়েকদিন ধরে বারবার সামনে আসছে। সাফল্যের মাঝে এগুলো ‘এক বালতি দুধে একফোঁটা গোবর চোনা’-র মত। অতএব সাবধান।
তেইশ জন জেলা সভাপতি, তিন শতাধিক ব্লক সভাপতি, তিন সহস্রাধিক অঞ্চল সভাপতি, শতাধিক শহর সভাপতি, প্রায় বাহাত্তর হাজার বুথ সভাপতি সহ হাজার খানেক অন্যান্য পদাধিকারী এবং সাংসদ ও বিধায়ক। এদের মধ্যে সামান্য কয়েকজনের বিরুদ্ধে বারবার ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে রাজকীয় বাড়ি। এদের সামনে রেখে পেছনে আরও অনেকেই আছে। মূলত এদের জন্যই দলকে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। সব বুথে জেতা সম্ভব নাহলেও সিপিএম আমলে তৃণমূল যেসব বুথে জিতেছিল, স্থানীয় মানুষের কাছে এদের ভাবমূর্তি এমন সেখানে দল হেরে গেছে। এদের জন্যেই দলনেত্রীর দিকে কুৎসিত আঙুল উঠছে। লক্ষ লক্ষ কর্মী-সমর্থকদের ভাবাবেগে আঘাত লাগছে। শহর থেকে দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও স্মার্ট ফোনের যুগে এদের কীর্তিকলাপ লুকিয়ে রাখা যাচ্ছেনা।
এখন দেখার আগামী ২১ শে জুলাই কার্যত বিরোধী শূন্য রাজ্যে এইসব মুষ্টিমেয় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দল কতটা কঠোর হতে পারে। দলের নীচু তলার কর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষ কিন্তু এটাই চায়। দলকে নুন্যতম নিয়ম-শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। ঢিলা দিলেই তৃণমূল রাজত্বের অবসান হতে সময় লাগবেনা।