মনোজ সিংহঃ সমুদ্রমন্থনে ওঠে অমৃতের ভান্ড। তাই নিয়ে দেবা অসুরে তুলকালাম কান্ড। তাই অমৃতকুম্ভের সন্ধানে ছুটে আসে পাহাড় চূড়ায়।
পুরান কাল থেকে দেব-দানব-অসুর-কিন্নর সবার মধ্যেই অমৃত লাভ করার লোভ ও অটুট বাসনা লক্ষ্য করা গিয়েছে। এই ভরা কলিকালেও মানুষের মধ্যে অমৃত লাভের আকাঙ্ক্ষা দিন দিন হচ্ছে প্রবল থেকে প্রবলতর। মানুষের চাওয়া পাওয়ার শেষ কখনোই হয় না। মানুষ নিজেকে অমর এবং দীর্ঘায়ু করার লক্ষ্যে এখনো ছুটে বেড়াচ্ছে সেই অমৃতকুম্ভের সন্ধানেই।
গতরাত্রে ১১ টা নাগাদ উপাসনা এক্সপ্রেস এ রওনা দিয়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় একঘুমেই পৌছালাম বিহারের রাজধানী পাটনা। এই পাটনার নাম ছিল পাটুলিপুত্র। বিশ্বজয়ী সম্রাট অশোকের রাজধানী। এই সম্রাট অশোক নাকি একদিন সমস্ত রাজ পাট ত্যাগ করে অমৃতের সন্ধানে ভগবান শ্রী গৌতম বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়েছিলেন এবং অমৃত লাভও করেছিলেন। আমাদের সকাল এই পূর্ণভূমিতে হওয়ায় নিজেদেরকে ধন্য মনে করলাম। পরম পিতা পরমেশ্বর এর কাছে পাটলিপুত্রের এই পুণ্যভূমি থেকে সূর্য উদয় দেখে আগামী দিনে অমৃত লাভের লোভ আরো বেড়ে গেল। সূর্যদেব যতই গগনে নিজের মাথা উঁচু করছেন ততই আমার মধ্যে একটা গুপ্ত ক্লেশ নাড়া দিয়ে উঠছে। আমার বাড়ির ঠাকুরঘরে দেবাদীদেব মহাদেবের নিত্য সেবা থেকে বঞ্চিত হলাম আমি আজ। কিন্তু দেবাদিদেব মহাদেব আমার মনের গোপন কথা আমার অজান্তে জেনে গেলেন এক মুহুর্তে। ঠিক সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের উপাসনা এক্সপ্রেস কাশি বিশ্বনাথের শহর বারানসি প্রবেশ করলো। অমৃতধারা মা গঙ্গার সেতুর ওপর দিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব কাশি বিশ্বনাথের শহর বারানসি প্রবেশ। কাশি বিশ্বনাথ যেন স্বয়ং আমাকে বলছেন – ‘আই আমার নিত্য সেবাটা তুই আমার নিজের শহরে এসে জলাভিষেক করে যা।’ কিন্তু, এখানে ট্রেনের স্টপেজ মাত্র দশ মিনিট , তাই রেলস্টেশনের মধ্যে দাঁড়িয়েই শ্রী শ্রী কাশী বিশ্বনাথের জলাভিষেক করলাম বোতলবন্দী জল ঢেলে প্ল্যাটফর্মে। মনের ভেতর থেকে অনুরোধ করলাম দেবাদীদেব মহাদেবকে আমার এই জলাভিষেক যেন তার উপর বর্ষিত হয়। কাশী বিশ্বনাথ ধাম ভারতবর্ষের হিন্দু ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এক মহামিলন ক্ষেত্র ও পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থান ভূমি। পুরান অনুসারে এই কাশী বিশ্বনাথের শহর বারানসি আছে দেবাদীদেব মহাদেবের পাসুপদ (ত্রিশূল ) অস্ত্রের ফলার ওপরে। পুরান কালে থেকে বর্ণিত আছে যখন সৃষ্টিতে প্রলয় হবে সারা পৃথিবী ধ্বংস হলেও এই কাশী বিশ্বনাথ ধামের বারানসি শহর থাকবে অক্ষত এটাই নাকি দেবাদী দেব মহাদেবের আশীর্বাদ। শুদ্ধ মনের অন্তর থেকে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে প্রার্থনা জানালাম যাতে আমার অমৃত কুম্ভের সন্ধান সার্থক হয়। কয়েক মুহূর্তের পর বারানসি স্টেশন ত্যাগ করল উপাসনা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলে উপাসানা পৌছালো ভারতবর্ষের সবথেকে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনৌ রেলওয়ে স্টেশনে। এক চা বিক্রেতার কাছ থেকে জানতে পারলাম এই লখনৌ রেলওয়ে স্টেশনের স্থাপত্য নাকি একটি দাবা খেলার ছকের মত করে তৈরি। যদিও আমি এ বিষয়ে সঠিক ধ্যান ধারণা রাখি না। তবে, ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে স্টেশনের মাথার চুড়াগুলো দেখে কথাটা কিছুটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছেও করল। বিকেলের চা বিস্কুট সেরে যখন শরীর উৎফুল্লতায় ভরে উঠল, ঠিক তখনই, নজরে এলো সদ্য ভারতীয় রেল দ্বারা যে সাতটি রেল স্টেশনের নামের পুনর নামকরণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি উত্তরপ্রদেশের আমার সামনে পুরনো নিহালগড় স্টেশন যা এখন মহারাজা বিজলি পাশি স্টেশন। জানতে পারলাম উত্তরপ্রদেশের মধ্যযুগীয় সময় সবচেয়ে বিশিষ্ট পাশি নেতাদের একজন ছিলেন এই বিজলী পাশি। তিনি নাকি উত্তরপ্রদেশের একটি বিরাট অংশে বহুকাল শাসনও করেছিলেন। বাবা ভিমরাও আম্বেদকর, রাম বিলাস পাশওয়ান, প্রাক্তন সাংসদ কাশীরাম সহ একাধিক ব্যক্তিত্ব এই পাশি সম্প্রদায় থেকে সম্পর্কিত। ২০০০ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগের একটি অনুষ্ঠানে মহারাজা বিজলীপাশির নামে একটি ডাক টিকিট ও বের করা হয়েছিল।
এদিকে সান্ধ্যকালীন আড্ডায় মেতে উঠেছে বি-১ কামরায় সকল যাত্রীরা। কেউ নিজের মোবাইলে ভজন শুনছেন, তো কেউ আবার জনপ্রিয় হিন্দি গানের কলিতে তাল ঠুকছেন। এরই মধ্যে কানে ভেসে এলো একটা অন্যরকম বেশ কয়েকটি গানের কলি। সহজেই বুঝে ফেললাম যে এ গান আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশের গান। কিন্তু আবার এ কথা ভেবেও অবাক হলাম কি করে এই কামরাতে এমন বাংলাদেশী জনপ্রিয় গানের শ্রোতা এলো। সাংবাদিকতার খোঁজখবর করার চরিত্রটা আরেকবার ট্রেনের মধ্যেই ফুটে উঠলো। দু একটা সারি পার হতেই দেখলাম এক গুচ্ছ বাংলাদেশি হিন্দু যুবক কেদারনাথের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে এবং তারাই বাংলাদেশী ভাষার ওই গানটি সযত্নে বাজাচ্ছেন ও আনন্দ উপভোগ করছেন। তারা বাংলাদেশ থেকে এই কম বয়সে তীর্থ করতে এসেছেন জেনে তাদের দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছে হলো। খুব বেশি কিছু না বললেও তারা আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে তাদের দেশের আকাশ এখন কালো মেঘে ঢাকা। তাদের মধ্যে একজন সেন্টু হঠাৎই বলে বসলো ভারত আমাদের নিজেদের দেশ। বাংলাদেশে যে অবস্থা চলছে বাবা-মা প্রায় দিনই বলে বাংলাদেশ ছেড়ে আমার পিসির বাড়ি ভারতবর্ষে গিয়ে পাকাপোক্তভাবে বসবাস করার ইচ্ছে রয়েছে। একজন হিন্দু ভারতীয় হিসেবে তাদেরকে সান্তনা দিয়ে এ কথাটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম ভারতবর্ষ কখনো বাংলাদেশকে নিজেদের শরীরের বাইরের অংশ মনে করে না। যদি কোন দিন প্রয়োজন পড়ে তাহলে ভারত তার মিত্র দেশের সহায়তার জন্য সারা পৃথিবীর সঙ্গযুদ্ধ করতে পারে।
ট্রেনের গতি যত মন্থর হচ্ছে, আমাদের সময় কখন যে রাত্রি দশটা বাজলো, গল্প গুজবের মাঝে কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার সহযাত্রী উমেশ খিদের জ্বালায় বেশ কচমচ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি দাদা আর কতক্ষণ আড্ডা মারবে এবার আমাদের সিটে এসো।” বুঝতে আমার দেরি হলো না উমেশের খিদে পেয়েছে। রাত্রিকালীন খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ির সাথে কিছুক্ষণ ভিডিও কনফারেন্সিং এ কথা বলে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম কিছুই বুঝলাম না। গভীর ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ যেন ওঠো ওঠো রব শুনতে পেলাম কানে। চোখ খুলে দেখি উমেশ সমস্ত ব্যাগ পত্র গুছিয়ে তৈরি। জিজ্ঞেস করলাম হরিদ্দার কি এসে গেছে? বলল হ্যাঁ । গভীর ঘুম থেকে উঠে টলতে টলতে একপ্রকার স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম হরিদ্দার রেল স্টেশনের অটো স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে অটো নিয়ে ভোর চারটে নাগাদ পৌঁছালাম হরিদ্বারের বিখ্যাত ‘হার কি পৌরি’ ঘাটে। ব্রহ্মমুহূর্তে গঙ্গাস্নান সেরে সারা শরীর শীতল হয়ে গেল। ক্লান্তি মুছে গেল। নতুন উদ্যমে অপেক্ষা করলাম সরকারিভাবে গঙ্গা আরতি দেখার জন্য ঘাটের পাশে। ভোর পাঁচটা চল্লিশ নাগাদ শুরু হল গঙ্গা আরতি। কিছুক্ষণের যেন মর্তলোকের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা- বেদনা ভুলে স্বর্গসুখের অনুভব করছিলাম। আমার প্রিয় পাঠকদের জন্য রইল সেই গঙ্গা আরতির কিছুক্ষণের ভিডিও…………
গঙ্গা আরতি শেষ হতেই আমাদের শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ আমাদের ভাড়া করা সুইফট ডিজায়ার গাড়ির ড্রাইভার সুগ্রীব ফোন করে জানালো সে গঙ্গার অপর প্রান্তে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। গঙ্গা সেতুর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কুয়াশার মাঝখান চিরে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে উঠে বসলাম সুইফট ডিজার গাড়িতে। গন্তব্য শ্রী শ্রী যমুনোত্রী ধাম।
চলবে…….