eaibanglai
Homeএই বাংলায়শিক্ষারত্ন' পুরস্কার পেতে চলেছেন বর্ধমানের প্রধান শিক্ষক

শিক্ষারত্ন’ পুরস্কার পেতে চলেছেন বর্ধমানের প্রধান শিক্ষক

নীহারিকা মুখার্জ্জী চ্যাটার্জ্জী, পূর্ব বর্ধমান:- শিক্ষক হিসাবে নিজেদের অবদানের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জ্জীর আমলে রাজ্যের সরকারি ও সরকার পোষিত বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য চালু হয়েছে ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কার। এবার অন্যান্যদের সঙ্গে এই পুরস্কার পাচ্ছেন বর্ধমান রথতলা মনোহর দাস বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ২৮ শে আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের স্কুল শিক্ষা কমিশনারের পক্ষ থেকে একটি চিঠির মাধ্যমে (মেমো নং: 518 (39)/1(2)-Phy Edn DSE-23027/2/2023-PHED SEC-DSE) বিনায়ক বাবুকে এই সুখবরটি দেওয়া হয়। জানা যাচ্ছে আগামী ৫ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসের দিন কলকাতায় বিশ্ববাংলা মেলা প্রাঙ্গনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিনায়ক বাবু সহ অন্য ‘শিক্ষারত্ন’ প্রাপক শিক্ষকদের হাতে এই সম্মাননা তুলে দেওয়া হবে।

পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর বিনায়ক বাবুর শিক্ষক জীবন শুরু হয় গৃহশিক্ষক রূপে। তখন থেকেই ছাত্রদরদী শিক্ষক রূপে তিনি চিহ্নিত হন। গরীব ছাত্রদের কাছে যেমন তিনি বেতন নেননি তেমনি নিজের সামান্য আয় থেকেই অনেক সময় তাদের বই, খাতা, পেন সহ বিভিন্ন শিক্ষাসামগ্রী কিনে দিয়েছেন। একে একে তিনি গুসকরা পি পি ইনস্টিটিউশন, গুসকরা মহাবিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ), মানকর কলেজ সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী শিক্ষক হিসাবে নিজের যোগ্যতা ও ছাত্রদের প্রতি দরদের সাক্ষর রাখেন। ২০০২ সালে এসএসসিতে উত্তীর্ণ হয়ে বর্ধমানের ইছলাবাদ হাইস্কুলে সহশিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। সেখানে থাকার সময় ছাত্রীদের স্বার্থে সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে বর্ধমান এম ইউ সি উইমেন্স কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের ‘ক্লাস’ নেন। একটানা ১৭ বছর ইছলাবাদ হাইস্কুলে থাকার পর ২০১৯ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসাবে গলসী হাইস্কুলে যোগদান করেন। করোনা আবহে মাত্র দুই বছর তিনি সেখানে থাকলেও নিজগুণে এলাকাবাসীর ভালবাসা অর্জন করেন। ২০২১ সালে প্রধান শিক্ষক হিসাবে বর্ধমানের রথতলা মনোহরদাস বিদ্যানিকেতনে যোগদান করেন এবং আপাতত এখানেই কর্মরত আছেন।

মূলত নরম প্রকৃতির বিনায়ক বাবু যে প্রয়োজনে কঠোর হতে পারেন তার প্রমাণ তার সহকর্মীরা একাধিকবার পেয়েছেন। যদিও তার সহজ সরল আচরণের জন্য মোটের উপর সহকর্মীরা তার উপর খুব খুশি। তাইতো ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে অনেকেই রাত পর্যন্ত তার সঙ্গে হাসিমুখে কাজ করে গেছেন।

শিক্ষকতার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি একজন স্নেহশীল পিতা। তাইতো দেখা যায় বাচ্চাদের মিড ডে মিলের ভাত মাখিয়ে তিনি তাদের মুখে তুলে দিচ্ছেন। ছাত্রছাত্রীরা বিনা প্রতিবাদে হাসিমুখে তার পরামর্শ মেনে নিয়ে বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। মনখুলে নিজেদের সমস্যার কথা তার কাছে তুলে ধরছে। সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয়ের অনুপস্থিত ছাত্রদের খোঁজে তাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হচ্ছেন। নিজে দুর্ঘটনায় আহত হয়েও ইনচার্জ হিসাবে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়েছেন।


এমনকি তার প্রতি অভিভাবকদেরও একটা সম্ভ্রম লক্ষ্য করা যায়। জনৈক অভিভাবকের বক্তব্য – কোনোদিন ভাবিনি ছেলের খোঁজ নিতে প্রধান শিক্ষক আমার মত গরীবের বাড়িতে আসবেন। উনাকে আমার প্রণাম।

গুসকরা পুরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বিনায়ক বাবু বর্তমানে বর্ধমানের রেনেসাঁ উপনগরীতে থাকেন। পিতা সুশান্ত ব্যানার্জ্জী অবসরপ্রাপ্ত গণিতের শিক্ষক। নিজে শিক্ষক হয়েও একাংশ যখন সন্তানের পড়াশোনার দায়িত্ব গৃহশিক্ষকের উপর ছেড়ে দেন তখন সুশান্ত বাবু হাজার কষ্ট সহ্য করেও নিজ হাতে সন্তানকে গড়ে তোলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হলেও নিত্যযাত্রী হয়ে ৮৫ কিমি. দূরত্ব অতিক্রম করেন। গৃহবধূ মা কণিকা ব্যানার্জ্জী সন্তানের জন্য নিজের অনেক শখ আহ্লাদ ত্যাগ করেন। উচ্চশিক্ষিতা হয়েও স্ত্রী সোমা দেবী আজও সংসারের জটিলতা নিজের হাতে সামলে চলেছেন, নিজের দুই কন্যা সন্তানকে গড়ে তুলছেন। কিন্তু শিক্ষক স্বামীর সাধনার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করেননি। তার ছোট্ট প্রতিক্রিয়া – স্ত্রী হিসাবে আমি গর্বিত।

নিজের পড়াশোনার পেছনে বাবার পাশাপাশি মেজমামা জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীর অবদান অকুন্ঠ চিত্তে স্বীকার করেন বিনায়ক বাবু। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা মেজমামার কাছে লাভ করেছি। বাবার সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো সমস্যায় মামাকে পাশে পেয়েছি। বড় ভাগ্নের ‘শিক্ষারত্ন’ পাওয়ার খবর শুনে জ্যোতি প্রকাশ বাবু খুব খুশি। তিনি বলেন – শিক্ষক হিসাবে ভাগ্নের ‘ট্রাক রেকর্ড’ তার স্বপক্ষে কথা বলবে।

সন্তানের ‘শিক্ষারত্ন’ পাওয়ার খবর শুনে সুশান্ত বাবু খুব খুশি। অনেক কিছু বলতে চাইলেও আবেগে তিনি বিশেষ কিছু বলতে পারেননি। বিরাশি বছরের বৃদ্ধের চোখ দিয়ে শুধু জল গড়িয়ে গেছে। অস্ফুটে বলেন, আমার সন্তান যেন এরকমই থাকে।

গলসীর সুজন বাবু বলেন, অল্প সময়ের জন্যে হলেও বিদ্যালয়ের প্রতি বিনায়ক বাবুর দরদ আমরা কোনোদিনই ভুলবনা। নেহাত উনার মা-বাবা অসুস্থ তাই উনাকে আটকায়নি। সবাইকে নিয়ে চলার ক্ষমতা উনার আছে।

বিনায়ক বাবুর বর্তমান বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হলেন বর্ধমান দক্ষিণের বিধায়ক খোকন দাস। বিনায়ক বাবুর ‘শিক্ষারত্ন’ পাওয়ার খবর শুনে তিনি খুব খুশি। তিনি বলেন, উনি আমাদের গর্ব। আশাকরি উনার হাত ধরে একদিন এই বিদ্যালয় বর্ধমান শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ে পরিণত হবে। রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে প্রত্যেককে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

সহযোগিতার জন্য সহকর্মী, স্নেহের ছাত্রছাত্রী, শুভানুধ্যায়ী, পরিবারের সদস্য সহ প্রত্যেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিনায়ক বাবু বলেন, ব্যক্তি হিসাবে স্বীকৃতি আমি পেলেও এই সাফল্য সবার। আজ আমি খুব খুশি। আজ যদি আমার দাদু, ঠাকুমা, বড়দা (মায়ের বাবা), বৌমা (দিদিমা) বেঁচে থাকতেন খুব আনন্দ হতো। চিরপরিচিত শিশুসুলভ খুশিতে মেতে ওঠেন তিনি।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments