জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, গুসকরা, পূর্ব বর্ধমানঃ- ইডির আনা অভিযোগে জামিন পেলেও সিবিআইয়ের আনা অভিযোগে তিহাড় জেলে আটক ছিলেন বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মণ্ডল। ইতিমধ্যে একই অভিযোগে জেলবন্দী কেষ্ট-কন্যা সুকন্যা জামিন পেলে আশার আলো দেখতে পান তৃণমূল কর্মীরা। মোটামুটি তার পর থেকেই আগের মতই শুরু হয় ‘কেষ্ট’ বন্দনা। অনুব্রতের ছবি দিয়ে বহু তৃণমূল কর্মী সমাজমাধ্যমে পোস্ট করতে থাকেন ‘টাইগার ইজ ব্যাক’ ইত্যাদি। অবশেষে তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়। গত ২০ শে সেপ্টেম্বর ব্যক্তিগত ১০ লক্ষ টাকার বন্ড ও একাধিক শর্তের ভিত্তিতে অনুব্রতকে জামিন দেয় দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতের বিচারক। তার আইনজীবীর আশা আইনি প্রক্রিয়া মিটিয়ে দু’একদিনের মধ্যে জেল থেকে মুক্তি ঘটবে তৃণমূল নেতার।
প্রসঙ্গত গরু পাচারের অভিযোগে ২০২২ সালের ১১ ই আগষ্ট সিবিআই অনুব্রত মণ্ডলকে তার বোলপুরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে ইডি তাকে হেফাজতে নেয়। প্রথমে তিনি ছিলেন আসানসোল সংশোধনাগারে। পরে তাকে দিল্লির তিহাড় জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
বারবার নির্বাচনে পর্যুদস্থ হওয়ার পর বীরভূম জেলা ও রাজ্য সিপিএম ও বিজেপি নেতাদের অভিযোগ ছিল অনুব্রত বাহিনীর সন্ত্রাসের জন্য নাকি বীরভূমে তাদের দল প্রত্যাশিত ফল করতে পারছেনা। অন্যদিকে অনুব্রতের বক্তব্য ছিল, জেলায় ওদের কোনো সংগঠনই নাই মানুষ ভোট দেবে কেন? তার আরও বক্তব্য মানুষ মমতা ব্যানার্জ্জীর উন্নয়ন দেখে ভোট দিয়েছে। ওরা সন্ত্রাসের গল্প শুনিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
তার বক্তব্য যে ঠিক তার প্রমাণ পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচন। অনুব্রতের অনুপস্থিতিতেও লোকসভায় বীরভূমের দু’টি আসন তৃণমূল আগের থেকে বেশি মার্জিনে জয়লাভ করেছে। অনেকের আশঙ্কা কেষ্ট জেলায় ফেরার পর নীচু তলার সিপিএম ও বিজেপি কর্মীদের আর হয়তো দলের হয়ে কাজ করতে দ্যাখা যাবেনা। অতীত অভিজ্ঞতায় তারা জানে বিপদের দিনে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের পাশে থাকবেনা। জেলায় এই দু’টি দল কার্যত সাইনবোর্ড সর্বস্ব হয়ে পড়বে।
জেলায় কেষ্ট ফেরার পর তৃণমূলের মধ্যেও সমস্যার সৃষ্টি হবে। কেষ্টর প্রতি দলনেত্রীর আবেগ কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। অন্যান্য জেলবন্দী নেতাদের নিজ নিজ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও প্রিয় কেষ্টকে কিন্তু দলনেত্রী পদ থেকে সরাননি, তাকে জেলা সভাপতি পদে রেখে দেওয়া হয়। হতে পারে বিরোধীদের মনস্তাত্ত্বিক চাপে রেখে দেওয়ার এটা একটা কৌশল! কেষ্টর অনুপস্থিতিতে দলের মধ্যে যাতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিতে না পারে সেই ভাবনাটাও দলনেত্রীর মাথায় থাকতে পারে। তাছাড়া তার অনুপস্থিতিতে কোনো সর্বজনগ্রাহ্য নেতাও বীরভূমে গড়ে ওঠেনি।
এখন কেষ্ট বীরভূমে ফেরার পর কেষ্ট-কাজল দ্বন্দ্ব কি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে? তাছাড়া গত দু’বছর ধরে যেসব নেতারা প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক ছিল তাদের কী হবে? – এই প্রশ্নটা উঠতে শুরু করে দিয়েছে।
প্রায় দু’বছর ধরে আউসগ্রাম, মঙ্গলকোট ও কেতুগ্রাম বিধানসভা এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস বোলপুর নেতৃত্বের প্রভাবমুক্ত হয়ে আগের মত পূর্ব বর্ধমান জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের নির্দেশে কাজ করছিল। কেষ্টর নির্দেশ অমান্য না করলেও অন্যদের নির্দেশ কতটা তারা মানতে চাইবে সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে! সেক্ষেত্রে অন্য সমস্যা দ্যাখা দিতে পারে। তাছাড়া এই মুহূর্তে এইসব এলাকার যেসব তৃণমূল নেতা পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটিতে আছে তাদের ভূমিকাই বা কী হবে – ভাববার বিষয়।
সবকিছুই নির্ভর করবে প্রায় দু’বছরের বেশি সময় ধরে জেলবন্দী কেষ্ট শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে কতটা সুস্থ থাকবেন এবং আগের মত দাপট দ্যাখাতে পারবেন কিনা তার উপর। তবে রাজনীতির ময়দানে তার উপস্থিতিটা যে সবাইকে চাপে রাখবে সেটা তার চরম শত্রুরাও স্বীকার করতে বাধ্য।
বিভিন্ন সময় সবচেয়ে বেশি মতবিরোধ ঘটেছে তৃণমূল নেত্রী মল্লিকা চোংদারের সঙ্গে। সেই মল্লিকা বললেন, কেষ্টদার উপস্থিতিটাই যথেষ্ট। যতই আমার সঙ্গে মতবিরোধ হোক তিনি থাকলে কর্মীদের মনে যে সাহসের সঞ্চার হয় সেটা অস্বীকার করা যাবেনা।