eaibanglai
Homeএই বাংলায়অমৃত কুম্ভের সন্ধানে পর্বঃ- ০৩, পাণ্ডবদের জীবনযাত্রা ছুঁয়ে শেষে পৌঁছলাম যমুনোত্রীর দরজায়

অমৃত কুম্ভের সন্ধানে পর্বঃ- ০৩, পাণ্ডবদের জীবনযাত্রা ছুঁয়ে শেষে পৌঁছলাম যমুনোত্রীর দরজায়

মনোজ সিংহঃ- মাইকেল মধুসূদনের ” জন্মিলে মরিতে হবে ‘ সবাই জানে, মানে। তাও অমরত্ব, দুর্লভ অমৃতের তীব্র লোভ তামাম মানবজাতির মধ্যে এমন ভাবে অন্তর্নিহিত রয়েছে, যে তার জন্য গরল পান করতেও পিছপা হয়না মানুষ। শুধু মানব জাতিকেই বা এ দোষ দেওয়া কেনো? সেই পুরান কালে দেব ,দানব , অসুর, কিন্নরদের মধ্যেও অমরত্বের জন্য এই লালসার বর্ণনা বিস্তর লক্ষ্য করা গিয়েছে। কোথায় মেলে সেই অমৃতের ভান্ড, আর কি ভাবেই বা হয় কাঙ্খিত অমরত্ব লাভ, তার লালসা ও খোঁজ এখনো চালাচ্ছে সমগ্র মানবজাতি প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। বিশ্ব জুড়ে বড় বড় সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে নিরন্তর চলছে তার গবেষণা।

রবিবার সকালে হরিদ্বারে ব্রম্ভমুহুর্তে পবিত্র ‘হর কি পৌড়ী’ ঘাটে গঙ্গা স্নান করে আমরা অপেক্ষমান ভাড়া করা সুইফট ডিজায়ার গাড়িটিতে ফের বেরিয়ে পড়লাম অমৃতকুম্ভের সন্ধানে শ্রী শ্রী যমুনোত্রী ধামের উদ্দেশ্যে। গাড়ির চালক সুগ্রিব জানালো মোট ২২৬ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছাব যমুনোত্রী ধামে। ভোরের কুয়াশা চিরে আমাদের সুইফট ডিজার গাড়ি ছুটলো বাম হাতে ঋষিকেশ রেখে সোজা দেহরাদুনের উদ্দেশ্যে। গত রাত থেকে পেটে তেমন কিছুই পড়েনি, তাই ড্রাইভারকে সকালবেলার এক পেয়ালা চা সাথে একটু টা যাতে জোটে দেখতে বললাম। ড্রাইভার সুগ্রিব একরাশ হাসি নিয়ে বলল “আপনাকে আমি সেভেন স্টার ‘হায়াত’ হোটেলের উল্টো দিকের ঢাবায় চা খাওয়াবো দেহরাদুন শহরের বাইরে পৌঁছে।” যেমন কথা তেমন কাজ। সকাল ৮ টা ১৫ নাগাদ আমরা পৌছালাম দেহরাদুন শহরের সব থেকে অভিজাত হোটেল ‘হায়াতে’র উল্টো দিকের ফুটপাতের ধারে থাকা ঢাবাতে। গরম গরম চায়ের সাথে বিস্কুট খেয়ে আবার শুরু করলাম যাত্রা পাহাড় রানী মসূরী শহরের দিকে। মসূরী শহরের ভিউ পয়েন্ট থেকে দেহরাদুন শহরের ছবি তোলার পর আমরা এগিয়ে চললাম ‘কেমটি ফলসের’ দিকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে সকল পর্যটক এই পাহাড়ের সুন্দর ছোট্ট জায়গাটিতে আসেন বেড়াতে তারা নিশ্চয়ই একবার যান এই ‘কেমটি ফলস’ দেখতে।

সকাল ১১ টায় কেমটি ফলসের সামনে একটি ছোট্ট দাবায় সকালের খাওয়া দাওয়া সেরে মসূরী শহরের ঠিক পেছন দিকের অংশে শুরু হল আমাদের যাত্রা শ্রী শ্রী যমুনোত্রী ধামের উদ্দেশ্যে। দু চোখ ভরে প্রকৃতির অপরূপ সুন্দরতা দেখে মন মুগ্ধ হচ্ছিল। কেমটি ফলস ছাড়িয়ে প্রায় ৫-৭ কিলোমিটার পেরিয়ে যাওয়ার পর ড্রাইভার সুগ্রীব জানালো – এখন নাকি যে এলাকাটা দিয়ে আমরা যাচ্ছি তাকে গাড়ওয়ালী ভাষায় ‘রাওয়াই ঘাটি’ বলে । আমরা বাঙালিরা হয়তো হিন্দি ঘাটি শব্দটির সাথে ওয়াকিবহুল নয়। তাই জানিয়ে রাখি ঘাটি শব্দের মানে হলো একটি পাহাড়ি এলাকা বা পাহাড়ি উপত্যকা। ড্রাইভার সুগ্রীব জানালো এই এলাকাতে মহাভারত কালের পাণ্ডব প্রথা প্রচলিত আছে। আজও বেশ কিছু দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এই পাণ্ডব প্রথার প্রচলন রয়েছে। হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করলো কি এই পাণ্ডব প্রথা? ড্রাইভার সুগ্রীব পারিবারিক বয়স্ক লোকদের কাছ থেকে শোনা এক মনোরম গল্প শোনালো, যা এইরকম – “এই এলাকায় যে সকল গাড়ওয়ালী মানুষজনেরা থাকেন তাদের সমাজের নিয়ম-কানুন সব এখনো নাকি সেই মহাভারতের পাণ্ডবদের মতন। মহাভারতের পঞ্চ পান্ডবদের বনবাস চলাকালীন বড় ভাইয়ের বিবাহিত স্ত্রীকে সকল ভাইয়েরা নিজেদের স্ত্রীর সম্মান দিতেন। ঠিক তেমনই এই এলাকায় আজও দূরদূরান্ত পাহাড়ি গ্রামে বাড়ির বড় ছেলের বিবাহিত স্ত্রী, বাড়ির সকল ছোটো ভাইদের স্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হয়। শুধু তাই নয়, ওই বাড়ির সমস্ত ছোট ভাইয়েরা তার দাদার স্ত্রীর সাথে সহবাস করার অনুমতিও পেয়ে থাকেন। ওই সম্পর্কের থেকে যেসব সন্তানেরা জন্মগ্রহণ করবে তারা সকল ভাইদের সন্তান হিসেবে গণ্য করা হয়। এই পাণ্ডব প্রথা অনুযায়ী বড় ভাইয়ের স্ত্রী ছোট ভাইদের কাছে তাদের স্ত্রী হিসেবে ততদিনই গণ্য হবে, যতদিন না কোন ভাইয়ের বিয়ে হচ্ছে। যে ভাইয়ের বিয়ে হবে, সে তারপর থেকে তার বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে ‘ভাবিমা’ বা বৌদি রূপে সম্মান দেবে। বড় ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে বিবাহিত সেই ভাইয়েরা আর কোনরকম বৈবাহিক বা শারীরিক সম্পর্ক রাখতে পারবে না ।” এই অত্যাধুনিক কম্পিউটারের যুগেও এই ধরনের মতবাদ, জীবনযাপন এই এলাকায় প্রচলিত রয়েছে জেনে বেশ অবাকই হলাম। তবে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমান যুগে এই প্রথায় কিছুটা ভাটা পড়লেও, এখনো বহু দূরবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলিতে এই প্রথাই চালু আছে ‘রাওয়াই ঘাটি’র গৌরবের অলংকার হিসেবে।

গল্প করতে করতে আমরা বালাকোট ছাড়িয়ে শ্রী শ্রী যমুনোত্রী ধামের পথে এগিয়ে চলেছি। বহু জায়গায় রাস্তায় ধস নামার ফলে বারবার গাড়ি থামাতে হচ্ছিল। তবে, সরকারি কর্মচারীদের উদ্যোগে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কিন্ত ধসপ্রবন এলাকার ওপর দিয়ে ফের যানবাহন চলার সুব্যবস্থা করা হচ্ছে তৎপরতার সাথে, এটাও দেখলাম। আসলে,পর্যটনই তো এদের প্রধান আয়ের উৎস! বালাকোট থেকে শ্রী শ্রী যমুনোত্রী ধামের রাস্তাটি শুনলাম নাকি এবার ডাবল-লেন করা হবে। কিন্তু, এখন যে পরিস্থিতিতে রাস্তাটি রয়েছে তা গাড়ি চলাচলের জন্য খুবই বিপজ্জনক। প্রাণ হাতে করে যাওয়ার মতোই। যেকোনো সময় পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে ধস। বিশেষতঃ বর্ষায়। যে সকল হিন্দু তীর্থযাত্রী ওই দুর্গম এলাকার ওপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছেন, এক কথায় বলতে গেলে নিজের জীবন হাতের মুঠোয় নিয়েই তারা ছুটছেন সেই দুর্লভ আমৃতের খোঁজে। ওই রাস্তার অবস্থা আর তার করাল ভয়ংকরতা দেখে মনের ভেতর চাপা ভয়টা চোখে মুখে না ফুটিয়ে পরম পিতা পরমেশ্বর এর কাছে নিজেকে সপে দিয়ে অবশেষে এসে পৌছালাম শ্রী শ্রী যমুনোত্রী ধামের ঠিক এক কিলোমিটার আগে, একটি গাড়ওয়ালী গেস্ট হাউসে । তিন দিন লাগাতার চলমান থাকার পর এই প্রথম শরীরের ব্যথা, বেদনা , ক্লান্তির সাময়িক অবসান হল। রাত্রের অল্পবিস্তর খাবার খেয়ে, পরেরদিন শ্রী শ্রী যমুনোত্রী ধামের পথে পায়ে হেঁটে পৌঁছাবার বাসনা নিয়ে নিশি যাপন করলাম ওই গাড়ওয়ালী গেস্ট হাউসেই। আরেকটা স্বপ্নভরা দিনের আকাঙ্ক্ষায়!

চলবে…………

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments