eaibanglai
Homeএই বাংলায়অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, পর্বঃ- ৪ "শ্রীশ্রী যমুনোত্রী ধামে কাঁদিয়ে দিলেন শাহজাহান"

অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, পর্বঃ- ৪ “শ্রীশ্রী যমুনোত্রী ধামে কাঁদিয়ে দিলেন শাহজাহান”

মনোজ সিংহঃ- হিন্দু ধর্মের পবিত্র স্বর্গীয় শরবত হলো অমৃত। হিন্দু পূরণে বর্ণিত রয়েছে অমৃত কলসের কথা আর সমুদ্র মন্থনের মোক্ষ অমৃতের ভান্ড। তাহলে, অমৃতের কি এমন মায়াজাল যা ভারতভূমির আম মনুষ্য জীবনে সবার লালসার কারণ এই অমৃত ধারা? সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি তামাম দুনিয়ার মানুষ অমৃত কুম্ভের সন্ধানে ছুটেই চলেছে। একেক জনের কাছে অমৃতের ধরন অবশ্য একেক রকম। আমিও চলেছি অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, তার উৎস মুখে “শ্রীশ্রী যমুনোত্রী ধামে”উদ্দেশ্যে।

খুব ভোরে উঠে গিজারের গরম জলে স্নান করে পুজোর বস্ত্র জড়িয়ে যখন গাড়ওয়ালি গেস্ট হাউসের গেটে এলাম, দেখলাম ৩-৪ জন গাড়ওয়ালি কমবয়সি যুবক ৩-৪ টি ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের গেস্ট হাউসের গেটে। আমাকে দেখেই সোহাগের আপ্যায়ন – “গুরুজী আইয়ে। ঘোড়া মে যমুনাত্রী মাতাকা দর্শন কিজিয়ে!” অর্থ হল – আমি যেন ওদের ঘোড়ায় চড়ে যমুনোত্রী ধাম দর্শনে যাই। জিজ্ঞাশু মন থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, “কিতনা লোগে?” একগাল হাসি নিয়ে কম বয়সী ওই গাড়ওয়ালী যুবক বলে বসলো, “যো দিজিয়ে গা চলেগা।” অর্থ হল- যা দেবেন তাই চলবে। একটু জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলল, “সরকার ২৩০০ টাকা প্রতি তীর্থযাত্রী মূল্য ধার্য করেছে। প্রয়োজনে দু একশ টাকা কম দিলেও চলবে বলে জানায় সে।” আমার পরম প্রিয় গুরু ভাইয়ের শারীরিক অবস্থা গত তিনদিন লাগাতার চলমান থাকার ফলে, খুব একটা সুস্থতায় নেই। তাই তার কথামতো আমরা তিনজনের জন্য তিনটি ঘোড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। লক্ষ্য – শ্রীশ্রী যমুনোত্রী মাতার মন্দির।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,২৩৩ মিটার উপরে শ্রীশ্রী যমুনোত্রী ধামের মাতার মন্দিরটি অবস্থিত। হিমালয়ের চারটি সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় হিন্দু তীর্থস্থানের মধ্যে একটি অংশ এই “শ্রীশ্রী যমুনোত্রী ধাম।” যমুনোত্রী হল চর ধামের তীর্থযাত্রার সূচনা স্থল (শ্রীশ্রী গঙ্গোত্রী ধাম, শ্রীশ্রী কেদারনাথ ধাম এবং শ্রীশ্রী বদ্রীনাথ ধাম) হল বাকি তিনটি। যমুনোত্রীর প্রধান আকর্ষণ হল দেবী যমুনার মন্দির এবং ৭ কিমি দূরে জানকি চাট্টির পবিত্র তাপপ্রবাহ। সাধারণত চ্যালেঞ্জিং রুট বলেই এটিকে মনে করা হয়। এটি ব্যাকপ্যাকিং, বর্ডিং এবং ক্যাম্পিংয়ের জন্য একটি খুব জনপ্রিয় এলাকা। যমুনোত্রী মন্দির হলো দেবী যমুনাকে নিবেদিত সর্বোচ্চ মন্দির। যমুনা নদীর উদগম স্থলে স্নান করলে নাকি অকাল মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, বলে হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে।

গেস্ট হাউসের সামনে থেকেই খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে চলেছি শ্রীশ্রী যমুনা দেবীর মন্দিরের উদ্দেশ্যে। যত এগোচ্ছি ততই এই পাহাড়ি রাস্তার ভয়ংকরতা ও দুর্গম চরিত্রের প্রমাণ পাচ্ছি প্রতি পদে পদে। আমার ঘোড়ার সাথে থাকা গাঢ়ওয়ালি যুবক পংকজ জানালো, “গত বছর (২০২৩) এই শ্রীশ্রী যমুনোত্রী ধামে ৪০ জন তীর্থযাত্রী নাকি মারা গেছেন ও চারধাম যাত্রায় সব মিলিয়ে মোট ২৪৫ তীর্থযাত্রী মারা গিয়েছিলেন।” সাক্ষাৎ মৃত্যুকে উপেক্ষা করেও অকাল মৃত্যু থেকে রক্ষা পেতে ও অমৃতের সন্ধানে এবছরও বহু মানুষ পায়ে হেঁটে, পাল্কিতে বা ঘোড়ার পিঠে চড়ে রওনা দিয়েছেন যমুনোত্রী মায়ের মন্দিরের উদ্দেশ্যে। খাড়া পাহাড়ের চড়াই উতরাই পথে পঙ্কজ লাগাতার তার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে থাকে। যতো শুনি, ততো ভয়, শঙ্কা চেপে ধরে মনের কোণে। তবে, অমৃত লাভের চাপা উত্তেজনা সে ভয়কে জয় করতে নিরন্তর এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগালো। ওই যুবক জানালো, পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে তার বাড়ি। দুই বোন ও এক ছোট ভাইয়ের সংসারে নিত্য দিনের অভাব অনটন লেগেই রয়েছে। তাই তার আর পড়াশোনা করা হয়নি। কিন্তু ছোট ভাই বোনদের সে পড়ানোর জন্য সরকারি স্কুলে ভর্তি করেছে। বাবা শারীরিক ভাবে অক্ষম হওয়ায়, এই কাঁচা বয়সেই তাকে রোজগারের জন্য পথে নামতে হয়েছে।

তাহলে প্রশ্ন হল এই ঘোড়াটি কার? পঙ্কজ জানায়,”গ্রামের পণ্ডিতজির তিন-চারটি ঘোড়া আছে। পাহাড়ি এলাকায় ঘোড়াকে একমাত্র পণ্যবাহী বাহনের মতন ব্যবহার করা হয়। সারা বছর গ্রামের মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্যে থেকে রোজগার হয় তাদের।” আর যে ছয় মাস চারধাম যাত্রা চলে, অর্থাৎ বাঙ্গালীদের অক্ষয় তৃতীয়া থেকে দীপাবলি অবধি, সে এই ঘোড়া নিয়ে তীর্থযাত্রীদের সেবায় তখন সদা নিয়োজিত থাকে। মাসে মাত্র তিন হাজার টাকা বেতন পায় সে। তাই দিয়েই চলতে হয় গোটা পরিবারের লোকজনদেরকে নিয়ে। কথায় কথায় কলকাতা থেকে আসছি শুনে কাতর আবেদন জানায় – একটা যেকোনো কাজ কলকাতার বুকে পাইয়ে দেওয়ার জন্য। সে নাকি শুনেছে কলকাতায় গেলে মানুষ বড়লোক হয়ে যায়। কিন্তু, আজকের কলকাতায় মানুষ বড় হচ্ছে নাকি ছোট হচ্ছে, তার হিসেব কি করে বোঝাই ওই কিশোর মনকে!

অবশেষে দীর্ঘ সাত কিলোমিটার ভয়ংকর পাহাড়ি রাস্তা ও নিশ্চিত মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে পৌছালাম জানকি চাট্টির পবিত্র তাপপ্রবাহ কুন্ডের সামনে। কুয়াশা ভরা পাহাড়ের কোলে অবস্থিত শ্রীশ্রী যমুনা মায়ের উষ্ণ কুন্ড। উষ্ণ কুন্ডে স্নান করে শ্রী শ্রী যমুনা মাতার দর্শন ও পূজো সারলাম। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে কথিত আছে – শ্রী শ্রী যমুনোত্রী মন্দিরে একজন মহান ঋষি, অসিত মুনি এই স্থানে বাস করতেন। পবিত্র যমুনা ও গঙ্গা উভয় নদীতে প্রতিদিন স্নান করতেন। কিন্তু সময় অতিবাহিত হলে তিনি বৃদ্ধ হয়ে যান এবং গঙ্গা নদীতে আর যেতে পারেননি। তাই, একদিন যমুনা নদীর পাশে গঙ্গা নদী দেখা দেয়, মা গঙ্গা তাকে তার আচার-অনুষ্ঠান চালিয়ে যেতে আশীর্বাদ করেন। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজনেরা গঙ্গা নদীর পরে দ্বিতীয় সবচেয়ে পবিত্র নদী হিসেবে যমুনাকেই মনে করেন। অন্যদিকে, পবিত্র গঙ্গা নদীর জল ও পবিত্র যমুনা নদীর জলের লবণাক্ততা এবং ঘনত্বের পার্থক্যে থাকার কারণে এই দুটি জল নিজেদের মধ্যে একটি পাতলা প্রাচীরের মত আস্তরণ তৈরি করে যা নাকি এই দুটি জলকে একত্রে মিশ্রিত হতে বাধা দেয়।

যদিও যমুনা নদীর উদগম স্থল থেকে ও গঙ্গা নদীর উদগম স্থল গোমুখ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে (বর্তমানে প্রয়াগরাজ)র ত্রিবেণী সঙ্গমে এরা একসাথে মিলিত হয়েছে সরস্বতী নদীর সাথে। যমুনা নদীর উৎস, গাড়ওয়াল হিমালয়ের পশ্চিমে বন্দর পঞ্চ পর্বতের এক প্রান্তে অবস্থিত। বন্দর পুঞ্চ রেঞ্জের কালিন্দী পর্বত থেকে যমুনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। এখানে ফুল, বিশেষ করে বন্য গোলাপ প্রচুর পরিমাণে জন্মে। যমুনোত্রী মন্দিরটি ১৮৩৯ সালে তেহরির রাজা নরেশ সুদর্শন শাহ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। ১৯ শতকে ভূমিকম্পের কারণে মন্দিরের একটি বিশাল অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে, মন্দিরটিকে জয়পুরের মহারানি গুলারিয়া দেবীর দ্বারা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। গ্রানাইট পাথর ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে যমুনোত্রী মন্দিরটিকে। শ্রী শ্রী যমুনোত্রী ধামের গর্ভগৃহে মা যমুনার কালো শিলার একটি মূর্তি রয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী মা যমুনার গায়ের রং কালো হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। যমুনা মায়ের বাহন কচ্ছপ। তিনি কচ্ছপের উপর দাঁড়িয়ে আছেন ও একহাতে জলের একটি পাত্র বা অমৃতের পাত্র ধারণ করে আছেন। শ্রী শ্রী যমুনা মাতা হলেন সূর্য দেবের কন্যা এবং মৃত্যুর দেবতা যমরাজের বোন। শ্রী শ্রী যমুনা মাতাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রধান প্রেমিকা বলেও কোথাও কোথাও হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ করা আছে।

হতভাগ্য আমি সদ্য মাতৃহারা হয়েছি বলে শ্রী শ্রী যমুনা মাতার মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করলাম না। কারণ আমাদের পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী কোন মন্দিরের গর্ভগৃহে আগামী একটি বছর আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শ্রী শ্রী যমুনা মাতার গর্ভগৃহের মূল প্রবেশদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে মা’কে প্রানভরে স্মরণ করলাম। ব্যাকুল মনের সকল প্রশ্নের উত্তরের ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম মন্দিরের দরজায়।

যমুনোত্রী ধামের আবহাওয়া মুহূর্তে মুহূর্তে বদল হতে থাকে। তাই, উপস্থিত মন্দির কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা দুর দূরান্ত থেকে অমৃতের তৃষ্ণায় ছুটে আসা বুভুক্ষু তীর্থযাত্রীদের সেখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে নিষেধ করেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুজো দিয়ে নিচে নেমে যাওয়ার উপদেশও সকলকে দিতে থাকেন ক্ষণে ক্ষণে। আমাদের উদ্দেশ্যেও সেই একই কথা বলা হলো বারে বারে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই মা’য়ের মাথায় অন্তরের সমস্ত প্রশ্নের ভার চাপিয়ে দিয়ে, জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত সৈনিকের ভেতরটা হঠাতই যেনো হিমালয়ের লঘু বাতাসের চেয়েও আরো হালকা হয়ে গেলো নিমেষে! বুঝলাম, এবার বাকি জীবন ধরে উত্তরের অপেক্ষায় থেকে যেতে হবে তীর্থের কাকের মতোই।

শরীর বিধ্বস্ত, মন কিন্তু এখন দারুন হালকা, তরতাজা। হিমালয়ের সফেদ চাদর, কুয়াশার মতো ধূমায়িত হীম বাষ্প ভেদ করে শরীরের চেয়েও মন চলে দ্রুত। পলকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার সদ্য প্রয়াত জন্মদাত্রীর মুখচ্ছবি, কঁকিয়ে ওঠে হৃদয় – বাড়িতে নিঝঝুম বসে থাকা বৃদ্ধ বাবার কথা মনে আসতেই। দুর্গাপুরের ইস্পাত নগরীর শ্রমিক আবাসনে রেখে এসেছি আমার অতীত আর ভবিষ্যতের দুই কর্ণধারকে। আবার অনুভব হলো- সব ওলটপালট হয়ে গেলেও, আমি কিন্তু সেই মাঝের জনা। বাঙালির একমাত্র মনের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের কথায় – ‘ঘরেও নহি, পারেও নহি, যেজন আছে মাঝখানে!” যমুনার উৎসে দাঁড়িয়ে একঝলক তাজমহলের কথাও মনে এলো। প্রেমের সৌধে চিরঘুমে থাকা স্ত্রীর পাশে অসহায়তার ব্যথা বুকে শুয়ে আছে প্রেমিক বাদশা। বৃদ্ধ শাহজাহান। সব বিলাস, যুদ্ধ, প্রতাপ, দেমাক যমুনায় বিসর্জনের পর ফকিরের আত্মগোপন! একফোঁটা জল চোখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এলো বৃদ্ধ প্রেমিকের জন্য। এইতো জীবন। মানুষ অমর নয়, রাজা আর ভিখারী – সকলের একই পরিণতি। তাও অমরত্বের লোভে ছুটে আসা!!

আবার ঘোড়ার পিঠে চড়ে মন্দির থেকে ফের রওনা দিলাম আমাদের গাড়ওয়ালী গেস্ট হাউসের দিকে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ঘোড়ার পিঠে চড়ে সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা সকলেই ফিরলাম গেস্ট হাউসে। এই যমুনোত্রী ধামের চড়াই উতরায়ে আমাদের শরীর এখন প্রায় ভগ্ন অবস্থায়। তাই রাত্রে অল্প খিচুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। আগামীকাল আমরা যাত্রা করবো পবিত্র গঙ্গা নদীর উদ্গম স্থল শ্রী শ্রী গঙ্গোত্রীর পথে। শুধু কি নিছকই পার্থিব মোক্ষের নেশায় ?

চলবে………

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments