মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ- ‘হমারি ওর শুভেচ্ছা? আপ হমারী মূখ্যমন্ত্রী হ্যায়। লেকিন দিদি কইসে ভেজেঙ্গে শুভেচ্ছা আপ কে পাস ?” – গালে হাত রেখে অবাক চোখে প্রশ্ন ইস্পাত নগরীর বি-জোনের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সুধা কুমারীর। চোখে মুখে বিস্ময়ের সাথে তার আরো জিজ্ঞাসা – “আপ ইস ছট মে হামে শুভেচ্ছা নেহি দেঙ্গে, দিদি ?”
আসলে তৃণমুল কংগ্রেসের তরফে দেওয়া অজস্র ওরকম পোস্টার কিন্তু সুধাদেরকেই শুভেচ্ছা জানাতে লাগানো। তাহলে, সুধা কেনো বুঝলো না ? সুধাই নয়, এরকম শত শত সুধাও ওই পোস্টার ঘিরে বিভ্রান্ত।
আসলে ওই ক্ষুদে পড়ুয়া সুধার নয়, গোড়ায় গলদটা দিদির দলের তরফেই। ছট পুজোর হিন্দি শুভেচ্ছা বার্তায় বানান ভুল, বাক্য ভুলের দারুন সুধার মত শিল্পাঞ্চলের শত শত হিন্দিভাষী বিভ্রান্ত। শুধু তাইই নয়, বিচলিত শাসক তৃণমুল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই। কারণ, তাদেরও মালুম হয়েছে – ফ্লেক্সে অসাবধানে ছাপানো ভুল বাক্যের দরুন আসলে একটি গোলমেলে বার্তাই চলে গেছে হিন্দিভাষীদের কাছে।
ঘাসফুলের দলীয় লোগো ব্যবহার করে, মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করে শহর তথা শহরতলিময় দেয়ালে দেয়ালে বড় বড় ফ্লেক্স, হোর্ডিং সাঁটানো ছট পুজোর শুভেচ্ছা পোস্টার। কে নেই সেই পোস্টারে ? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দলের ‘সেকেন্ড ম্যান’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রাজ্যের দুই মন্ত্রী মলয় ঘটক, প্রদীপ মজুমদার, সাংসদ কীর্তি আজাদ এবং দলের জেলা সভাপতি নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। দৃষ্টিনন্দন ওই হোডিংগুলি ইস্পাত নগরীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে তো বটেই, লাগানো হয়েছে মূলতঃ অবাঙালি অধ্যুষিত পাড়া-মহল্লাগুলিতে। কিন্তু, এখানে এসেই গলদ ধরা পড়েছে। তা নিয়ে কিঞ্চিত ক্ষুব্ধ হিন্দিভাষী মানুষজনেরা এই শিল্পাঞ্চলে।
কারণ ? ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের মতে এইরকম একটি পোস্টার বাজারে ছাড়ার আগে ঠিকঠাক হিন্দী জানা কারোর সাথে পরামর্শ করা উচিত ছিল না কি? শুভকামনার ওই পোস্টার গুলির শুভেচ্ছা বার্তার ভাষার ভূল ? কেন এমন হলো? দুর্গাপুজো বা দীপাবলীর শুভেচ্ছা বার্তায় এমন ভুল তো হয় না ? তাহলে, কোন রকমে ‘ধুরছাই’ করে একটি পোস্টার সাঁটিয়ে উল্টে এমন বিভ্রান্তি ছড়ানো ? তাও আবার রাজ্যের সব চেয়ে বড় দলের লোগো ব্যবহার করে ?
কিসের বিভ্রান্তি ?
“আসলে যে ভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে তার অর্থ এই – যে তৃণমূল কংগ্রেস নিজেই জনসাধারণের কাছে শুভেচ্ছা পাঠানোর প্রার্থনা করছে। বলছে- আপনারা আমাদেরকে শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রী সহ গোটা দলটাকে দিন। ওনারা কিন্তু ছটের শুভেচ্ছা কাউকে দিচ্ছেন না,” বললেন প্রভাকর মায়াঙ্ক। তিনি ইসিএল এর কাজোড়া এরিয়ার এক খনি আধিকারিক। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলেই ভাড়া ঘরে বসবাস করেন তিনি। তার ভাষায় “অন্ততঃ ওনাদের পোস্টারের ভাষা যা বলছে তার আক্ষরিক অর্থ এমনটাই হয়।” প্রভাকরের চেয়েও সূক্ষ্ম ভাবে হিন্দি ভাষার অপব্যবহার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন দুর্গাপুরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ডাইরেক্টর প্রফেসর অরবিন্দ চৌবে। তার কথায় “এসব ক্ষেত্রে আরেকটুকু যত্নবান হওয়ার দরকার ছিল।” তিনি বলেন, “দুটি বানান ভুল রয়েছে। প্রথমতঃ ওনারা ‘পুজা’ লিখেছেন। হবে পূজা। দ্বিতীয়তঃ শেষ লাইনে হার্দিক লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শব্দটিতে ‘ক’ টাই নেই। তার বদলে যে অক্ষরটি ছাপা হল তা যে আসলে কি তা বোধগম্যই হচ্ছে না।” আবার, তার চোখে প্রভাকরের মতোই একটি মস্ত ভুল ধরা পড়েছে। ড: চৌবে বলেন, “ওনারা লিখছেন- ‘সমন্বয় সমিতি কি ওর শুভকামনা’ যার অর্থ ওনারাই জনগণকে বলছেন উনাদেরকে শুভকামনা জানাতে। কিন্তু, ওটা আসলে হবে ‘সমন্বয় সমিতি কি ওর সে হার্দিক শুভকামনা’। কিন্তু ওখানে ‘সে’ শব্দটিই নেই।” নেই যখন তখন তা শোধরানোর আর তবে উপায়ও নেই। কারণ – শহর এখন ভুল পোস্টারে ছয়লাপ! কি ভাবছেন তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব ? দলের জেলা সভাপতি নরেন্দ্রনাথ বলেন, “যিনি লিখেছেন তার আরও যত্নশীল হওয়া দরকার ছিল। আমরা চেষ্টা করছি কি করে শোধরানো যায়।”
পোস্টারের ভাষা নিয়ে অবাঙালি বিদ্যজনেরা যা বললেন, তার চেয়েও চাঁছা-ছোলা ভাষায় তৃণমূল কংগ্রেসকে আক্রমণ করেছেন জেলা বিজেপি নেতৃত্ব। যে দলে অবাঙালির সংখ্যা অনেকটাই বেশি। তাদের দাবি “ওরা আসলে ছটের আবেগটাই জানেন না। হিন্দি সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টাও করেন না। কখনো পূজার ডালা তো কখনো কমিটি গুলিকে কিছু টাকা গুঁজে ভোট বৈতরণী পেরোণোর জন্যই এসব করছেন ওরা। এদের আসলে হিন্দি সংস্কৃতির প্রতি কোন শ্রদ্ধা ভালোবাসাই নেই।”
বিজেপির এমন টিপ্পনিতে বেজায় বিরক্ত দুর্গাপুরের সাংসদ কীর্তি আজাদ। বুধবার দুপুরে সাংসদ ওই ভাষাগত ত্রুটি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, “এসব নিয়ে অযথা রাজনীতি করার কোন মানে হয়? ওরকম ছোটখাটো ত্রুটি যাকে প্রিন্টিং এররই বলা যেতে পারে। সেখানে আটকে না থেকে আসল ভাবনাটাকে ধরতে হবে। এর মধ্যে যে ভালবাসা, শ্রদ্ধার ভাব সেটাকেই বড় করে দেখতে হবে। যারা নিচু নজরের, তারা চিরটাকাল এমন কূটকচালী করবেই। মানুষ ওসবকে পাত্তা দেয় না।”