সিরাজ রায়চৌধুরী, কাটোয়া:– তিনশো বছরের পুরনো কার্তিক লড়াই ফের হবে, তাই উত্তেজনায় কাঁপছে কাটোয়া আর দাঁইহাট। যেমন সাজো সাজো রব ছোট্ট এই দুই পুরনগরে, তেমনি কোমর কষছে পুলিশ, কারণ লাখ লাখ লোক বিভিন্ন গ্রাম, শহর, জেলা থেকে যে ছুটে ছুটে আসবে দুটি দিন – শনি, রবিবার।
রাজ্যের মধ্যে হুগলির বাঁশবেড়িয়া, বাঁকুড়ার সোনামুখীতেও কার্তিক পূজো হয় বটে, তবে এই কার্তিক লড়াই রাজ্যের অন্যত্র বিরল।তাই, প্রতি বছর কর্তিকপুজোর সময় এই দুই শহরের গরিমাই আলাদা!
গ্রামবাংলায় এখনও একটা ছড়া মুখে মুখে ঘোরে – কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা, একবার আসে মায়ের সঙ্গে একবার আসে একলা। আর যদি সেই কার্তিক পুজোর গল্প কাটোয়া কেন্দ্রিক হয় তাহলে তো কথাই নেই। ন্যাংটো কার্তিক, ধেড়ে কার্তিক প্রভৃতি হরেক রকমের কার্তিক লড়াই দেখতে প্রতিবছরই কাতারে কাতারে মানুষ হাজির হন কাটোয়ায়। এবছরও তার ব্যতিক্রম নেই। ১৬ নভেম্বর কার্তিক পুজো। আর তারপরের দিন শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। কার্তিক পুজোর শোভাযাত্রা হবে প্রায় ৪.৮ কিমি এলাকা জুড়ে। ফলে নিরাপত্তার প্রশ্নে সাজো সাজো রব এখন কাটোয়া জুড়ে।
কাটোয়ার অক্সিজেন ক্লাবের সদস্য বাবুলাল সেখ এবং বিজয় অধিকারী প্রমুখরা জানিয়েছেন, দুরকমভাবে কাটোয়ায় কার্তিক পুজো তথা কার্তিক লড়াই হয় – একটা মুভিং (শোভাযাত্রা) আর একটা স্ট্যান্ডবাই বা সিটিং (বড় প্যান্ডেল, লাইট, মূর্তি) ইত্যাদি। কোনও কোনও কমিটি দুটোতেই জোড় দেয়। বিগবাজেটের পুজো ১৫-১৮ টা। মোট ৮৩ টি পুজোর শোভাযাত্রা বের হয়। এরমধ্যে শোভাযাত্রা কেন্দ্রিক বড় পুজো করে অক্সিজেন, ঝংকার, টাউন ক্লাব, প্রতিবাদ, প্রতিবন্ধ ইত্যাদি। সিটিং বা বড় প্যান্ডেলে জোড় দেয় অক্সিজেন, ঝংকার, জয়শ্রী, জনকল্যাণ, আপনজন, নিউ-আপনজন, ইয়ংস্টাফ, দেশবন্ধু, বিদ্যাসাগরপল্লী ইত্যাদি। এবার সব থেকে বেশি বাজেটের পুজো করছে অক্সিজেন এবং ঝংকার। এরা মুভিং এবং সিটিং দুটোতেই জোড় দিয়েছে। ঝংকার এবার অক্ষরধাম মন্দির করছে। বাজেট প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা। অক্সিজেন-এ জব্বলপুরের ফেমাস ‘রাজকুমার’ ব্যান্ড আসছে। একদিনে ৩ লক্ষ টাকা নেবে। চন্দননগরের ডিস্কোলাইট থাকবে। বাজেট ১৬-১৮ লক্ষ টাকা। ইয়ংস্টাফ ক্লাবের বাজেট ১২ লক্ষ টাকা। ইউনিক ক্লাবের বাজেট ৮ লক্ষ টাকা। বিদ্যাসাগর পল্লীর বিদ্যাসাগর সংঘের বাজেট ৮ লক্ষ টাকা। এদের ব্যান্ডের বাজেট ২.৫-৩ লক্ষ টাকা। ইন্টারন্যাশনাল শ্যাম ব্রাস ব্যান্ড আসছে। আরও একটি ক্লাব ১.৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ব্যান্ড আনছে। অন্যান্য ক্লাব এত খরচ করে ব্যান্ড না আনলেও তাঁদেরও ভালোভালো ব্যান্ডই আসছে। পুরনো পুজোর মূর্তিগুলো সাধারণত ‘থাকা’ পদ্ধতিতে হয়। নতুনগুলোর বেশিরভাগ কার্তিকের সঙ্গে অন্য কোনও মূর্তি কেন্দ্রিক থিম করা হয়। অক্সিজেন ক্লাবে কার্তিকের সঙ্গে এবার থাকছে বাল গণেশ, ইউনিক ক্লাবে কালী ঠাকুর, ঝংকার-এ থাকার সাথে ইউনিক একটা কার্তিক করা হবে। স্টার গ্রুপ-এ কালো কৃষ্ণ। এঁরা জানিয়েছেন, কাটোয়ার এই কার্তিক লড়াই দেখতে বাইরে থেকে প্রচুর মানুষ আসেন। ঝংকার ক্লাবের সদস্য কালী চট্টোরাজ জানিয়েছেন, এবারের থিম অক্ষরধাম মন্দির। বাজেট ৩০ লক্ষ টাকা। মুভিং (শোভাযাত্রা) এবং সিটিং (প্যান্ডেল, লাইট, মূর্তি-সহ অন্যান্য) দুটোটেই জোড় দেওয়া হয়েছে। জলের উপর প্যান্ডেল। আলোর চাদরে রাস্তা ঢেকে দেওয়া হবে। বিষ্ণুর ১০ অবতারের ‘থাকা’ থাকবে। কে ডি আই মোড়ের স্টার গ্রুপের সদস্য অমরনাথ দাস জানিয়েছেন, তাদের থিম এবার কালো কৃষ্ণ থিম। ৫ লক্ষ টাকা বাজেট। লাইটের কাজ থাকবে। উল্লেখ্য, কাটোয়ার পাশাপাশি কালনা মহকুমার পূর্বস্থলী উত্তর বিধানসভা এলাকায় ১০০-র বেশি কার্তিক পূজা হয়। ভারতমাতা পুজো কমিটির উদ্যোক্তা তথা পূর্বস্থলী উত্তরের বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পূর্বস্থলী উত্তরের মাজিদা এবং পূর্বস্থলী অঞ্চলে প্রায় ১০০ টা বড় পুজো হয়। শোভাযাত্রা কম হয়। এখানের পুজোগুলোতে মুসলিমরা বেশি আসেন। বিধায়কের পুজোয় ৭ লক্ষ টাকা বাজেট।
কাটোয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান সমীর সাহা জানিয়েছেন, সুষ্ঠুভাবে উৎসবটি সম্পন্ন করতে তাঁরা কেন্দ্রীয় কমিটি তৈরি করে দিয়েছেন। পুলিশ-প্রশাসন সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে থাকে।
কাটোয়া থানার আইসি তীর্থেন্দু গঙ্গ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, দাঁইহাটে ৩.২ কিলোমিটার রাস্তায় শোভাযাত্রা হবে। কাটোয়ায় হবে ৪.৮ কিলোমিটার শোভাযাত্রা। ইতিমধ্যেই পুলিশের পক্ষ থেকে পুজো কমিটির নাম-সহ শোভাযাত্রা পরিক্রমার পথ নির্দেশিকা (রুট ম্যাপ) প্রকাশ করা হয়েছে। দুই জায়গাতেই প্রায় ২০০০ জন করে পুলিশ কর্মী এবং সিভিক ভলেন্টিয়ার থাকবে। কন্ট্রোল রুম, ক্যাম্প, সিসি টিভি ক্যামেরা, জায়ান্ট স্ক্রিন, ফায়ার, অ্যাম্বুলেন্স সমস্ত ব্যবস্থা থাকবে। ভারত স্কাউটস অ্যান্ড গাইডসের সদস্যরাও থাকবে।
এদিকে, কাটোয়ার কার্তিক লড়াই প্রসঙ্গে
আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ড স্বপনকুমার ঠাকুর জানালেন, “দেবসেনাপতি কার্তিক। সুঠাম চেহারা। মাথার চুল বাবরি করা। সরু গোঁফ তার দুধে আলতায় মেশানো গায়ের রঙ।। হাতে যুদ্ধাস্ত্র – তীর ধনুক।ঋকবেদে কার্তিকের উল্লেখ নেই। অথর্ববেদে কুমার নামে এক আগুনদেবতার সন্ধান মেলে।। বৈদিক যুগের শেষের দিকে কুমার ক্রমশ শৈবসাধনায় যুক্ত হয়েছে।এই কারণে কার্তিক শিবপুত্র।মহাভারতে দেখি কার্তিক ছয় ঋষিপত্নীকে মা বলে আপন করে নিলেন। এরা কৃত্তিকা নামে পরিচিত।সেই সূত্রে স্কন্দ বিশাখের নাম হলো কার্তিক।”
গবেষকদের মতে, কার্তিক লোকজ স্তর থেকে উঠে আসা দেবতা ।পতঞ্জলির মহাভাষ্যে স্কন্দ কার্তিককে ভয়ংকর লৌকিক দেবতা বলা হয়েছে।স্কন্দ মূলত যুদ্ধের দেবতা । শব্দটি এসেছে সংস্কৃত স্কন্ন থেকে।এর অর্থ বীজ বা বীর্য।বীর্য যার আছে সেই বীর্যবান অর্থাৎ সাহসী নির্ভীক শক্তিশালী।। আবার স্কন্দ শব্দের শব্দার্থ থেকে বোঝা যায় তিনি কৃষিদেবতা। একসময় চোর ডাকাতদের দেবতাও কার্তিক।কহলনের রাজতরঙ্গিণী থেকে জানা গেছে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে পুন্ড্রবর্ধনে অর্থাৎ আধুনিক উত্তরবঙ্গে প্রায় ঘরে ঘরে কার্তিক পুজো হতো।প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি মালদহের সাহাবাড়ির কার্তিক চতুর্ভুজ বাঁকিবিহারিলালের পুজো বিখ্যাত।এই পরিবারের বিশেষ প্রথা হলো প্রথম পুত্রসন্তান হলে একটি করে দেবপ্রতিমার বাড়তি সংযোজন।মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি এবং বেলডাঙা, হুগলির বাঁশবেড়িয়া, বাঁকুড়ার সোনামুখির কার্তিকপুজোও বেশ জমজমাট।
তবে কাটোয়ার কার্তিকপুজোই কেবল কার্তিক লড়াই নামে দক্ষিণবঙ্গে সুপরিচিত। প্রবাদ আছে বারবিলাসিনীদের কার্তিকপুজো আর শহুরে জমিদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এই নিয়ে শুরু হয়েছিল কার্তিকলড়াই। যদিও কাটোয়ার কার্তিকপুজো সম্পর্কে কাটোয়ার খ্রিষ্টান মিশনারিদের লেখায়, নিবারণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কাটোয়ার ইতিহাসে’ আদৌ কোন উল্লেখ নেই। কথিত আছে – বর্তমান হরিসভা পাড়ার বারবিলাসিনীদের ন্যাঙটো কার্তিকের উপাসনা থেকেই কার্তিক লড়াইয়ের সূত্রপাত। এই লোকশ্রুতিটুকু বাদ দিলে নিবিড় ক্ষেত্রানুসন্ধানে যা দেখা গেছে , ড. ঠাকুরের কথায়, “কাটোয়ার কার্তিকপুজোর উৎসের মূলে রয়েছে তার থাকাপুজো। শহর কাটোয়ার অন্যতম প্রাচীন জনবসতি তাঁতিপাড়া। এখানে রয়েছে ধর্মরাজের থান, বর্গিহাঙ্গামার স্মৃতিবাহী লক্ষ্মীনারায়ণজিউ মন্দিরসহ সাতভাই রাজার থাকা-কার্তিক। এই প্রাচীনপুজো্টির একাধিক বৈশিষ্ট্য মানত রীতি্তে পুজোপদ্ধতিতে দেখি।” প্রথম থেকেই বিশেষ প্রযুক্তিতে নির্মিত বাঁশেরথাকায় এর পুজো হচ্ছে। সাধারনত একাধিক মূর্তি একটি ফ্রেমে সন্নিবেশ করতে হলে চালির সাহায্য নিতে হয়। যেমন সাত পুতুলের জন্য দুর্গার একচালিমূর্তি চালু হয়েছিল।কিন্তু, পুতুলের সংখ্যা যখন ২৫ থেকে ৩০র মধ্যে হয় তখন স্বল্প পরিসরে চালিতে আঁটা আর সম্ভব হয়না । এই সমস্যার জন্য বিশেষ লোকপ্রযুক্তিতে নির্মিত বাঁশ দিয়ে নির্মিত এই থাকা যা আদতে একটা সিঁড়ির মত গ্যালারি।উচ্চতায় ১৫ থেকে ২০ ফুট কিন্তু চওড়া মাত্র ছয় থেকে সাত ফুট সমকোণি ত্রিভূজাকৃতি থাকায় একসাথে ৩১টা পুতুল অনায়াসে ধরবে।
আনুমানিক অষ্টাদশ শতকে এই থাকার উদ্ভব। প্রথম যুগে থাকা এতবড়ো ছিল না । ধীরে ধীরে তার বিবর্তন ঘটেছে। থাকায় ক্রমশ যাত্রাশিল্পের প্রভাব পড়েছে।মহাভারত পুরাণাদির নানা নাট্যকাহিনিকে মৃৎপ্রতিমার মধ্যদিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই বিশেষ লোকপ্রযুক্তিটি সারা বাংলায় একমাত্র কাটোয়া, দাঁইহাট অঞ্চলেই দেখা যায়।থাকার এই আদি রূপটি আজও টিকে আছে তাঁতিপাড়ার সাতভাই কার্তিকের সাত পুতুলের বিন্যাসে। কাটোয়ার মুহুরিবাড়ির জগদ্ধাত্রীপ্রতিমা নির্মাণে এই আদিম থাকার প্রভাব আছে।পরবর্তীকালে কাটোয়ার জমিদার আর ব্যাবসাদাররা মিলে এই থাকাতেই কার্তিকপুজোর প্রতিযোগিতা বা লড়াই শুরু করেন বিশ শতকের গোড়ারদিকে।
এমন অধিক সংখ্যক বৈচিত্রপূর্ণ থাকা পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও দেখা যায় না।থাকার বিষয় রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণের কাহিনি। যেমন, রামের বনবাস,সীতার বিবাহ,কৃষ্ণের জন্ম,দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ,বকাসুর বধ ইত্যাদি।একজন কাঠামো শিল্পী, পোষাক শিল্পী, ও নির্দেশকের সহায়তায় থাকা মঞ্চস্থ হয়।সবার উপরে থাকেন দেবী জগদ্ধাত্রী অর্থাৎ কাত্যায়ণী। তাঁর কোলে থাকে শিশু কার্তিক।দু পাশে পাঁচ থেকে ছয়টি করে নৃত্যরতা সখী।মাঝে সংশ্লিষ্ট কাহিনির চরিত্রাবলী। থাকা বর্তমানে কমে এসেছে। ক্রমশ থাকাকে হটিয়ে থিমকে নিয়ে জমে ওঠেছে কার্তিক লড়াই।