সংবাদদাতা,বাঁকুড়াঃ– রাত পোহালেই ‘মকর সংক্রান্তি’। হিন্দু শাস্ত্র মতে, এই দিনটি সূর্যের ‘মকর’ রাশিতে প্রবেশকে চিহ্নিত করে। সূর্যের এই রাশি পরিবর্তন ‘সংক্রান্তি’ নামে পরিচিত। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পৌষ মাসের শেষ দিনটি মকর সংক্রান্তি। এই দিনটি সারা দেশ জুড়ে পালিত হয়। তবে স্থান বদলে এর নাম বদলে যায়। কোথায় বিহু, কোথাও পোঙ্গল, কোথাও লোহরি, কোথাও উত্তরায়ণ, আবার কোথায় সংক্রান্তি। মূলত কৃষি নির্ভর ভারতে এই সময়ে পাকা ধান মাঠ থেকে বাড়িতে ওঠে। তাই এই মকর সংক্রান্তিতে কৃষকরা উৎসব পালন করেন। স্নান, পুজো-পাঠ, নতুন চাল দিয়ে নানা পদ তৈরি ও লোকাচার, রীতি মেনে পালিত হয় দিনটি। তবে বাঙালির কাছে এটি পিঠে পুলি উৎসব।
শহরাঞ্চলে সেভাবে এই উৎসব পালিত না হলেও এখনও গ্রাম বাংলায় ঘরে ঘরে মকর সংক্রান্তিতে রাত জেগে চলে পিঠে পুলি তৈরি। সকালে মকর স্নান করে শুরু হয় পিঠে খাওয়া। এই পিঠে পুলির মূল উপাদান হল চালের গুঁড়ো। এক সময় গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে সংক্রান্তির আগে ঢেঁকিতে চাল কোটা বা গুঁড়ো করা হতো। ঢেঁকির ধাপুর-ধুপুর শব্দে পুরো গ্রাম মেতে উঠত। জানিয়ে দিত উৎসবের আগমনী বার্তা। ষাট বা সত্তরের দশকেও গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরেই ঢেঁকি ছিল সংসারের অপরিহার্য একটি উপাদান। ঢেঁকি ছিলনা এমন বাড়ি ছিলনা বললেই চলে। দৈনন্দিন সংসারের সব কাজে ঢেঁকি ছিল একটি অপরিহার্য্য উপকরণ।
কথায় আছে ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’_ বাংলার এ প্রবাদ বাক্যটি বহুকাল ধরে প্রচলিত হলেও ঢেঁকি আর এখন ধান ভানে না। বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে ঢেকির জায়গা নিয়েছে বিদ্যুৎ চালিত চাল গুঁড়ো করার মেশিন। নাম মাত্র পরিশ্রমে খুব কম সময়ে তৈরি হয়ে যায় চালের গুঁড়ো। তাই গ্রাম বাংলা থেকে ঢেঁকি প্রায় হারিয়ে গেলেও বাঁকুড়ার ইন্দাস ব্লকের গোবিন্দপুর গ্রামে দেখা মিলল ঢেঁকির। সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে এই গ্রামে জোর কদমে চলছে চাল গুঁড়ো করার কাজ। নিকানো উঠোনে গ্রামের মহিলারা একত্রিত হয়ে দলবেঁধে করছেন সে কাজ। কেউ ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছেন, কেউ চাল এগিয়ে দিচ্ছেন, কেই গুঁড়ো চাল ছাকনি দিয়ে ছেকে নিচ্ছেন। আগে এই ঢেঁকি পাড় দিতে দিতে মহিলারা গাইতেন ‘ধান ভানার গান’, “ও ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে, আমি নাচি, হেলিয়া দুলিয়া, ও ধান ভানিরে।” ঢেকির দেখা মিললেও হারিয়ে গেছে সেসব প্রচলিত গান।
গোবিন্দপুর গ্রামের মহিলারা জানালেন ঢেঁকিতে তৈরি চাল গুঁড়োর পিঠেতে যে স্বাদ হয়, মেশিনে গুঁড়ো করলে তা হয়না। তাই পরিশ্রম আর সময় বেশী লাগলেও পিঠে তৈরির চালের গুঁড়োর জন্য ঢেকির উপরেই এখনো আস্থা রাখেন গ্রামের মানুষ। তবে যেভাবে ঢেকির ব্যবহার কমেছে তাতে সেদিন আর বেশী দূরে নয় যখন গ্রাম বাংলা থেকে একেবারে হারিয়ে যাবে বাঙালির ব্যবহারিক জীবনের এই প্রচীন যন্ত্র।