eaibanglai
Homeএই বাংলায়৭৫ লাখের জরিমানা, মুচলেকার পর পেয়াদার তদন্তে কবিকে ক্লিনচিট

৭৫ লাখের জরিমানা, মুচলেকার পর পেয়াদার তদন্তে কবিকে ক্লিনচিট

মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রভাবশালী ছিলেন এক কথায় ঠিকঠাক জবাব হয়তো মিলবে না, তবে, দুর্গাপুরের কবির প্রভাব কতটা জানতে চাইলে এক কথায় প্রায় সব্বাই ঘাড় কাত করে মাথা নুয়ে বলবেন – ‘উনিইতো এখন দুর্গাপুরের ভগবান! মস্ত প্রভাবশালী।’

কবি দত্ত প্রভাবশালী না হলে তার হোটেলের বেআইনি নির্মাণ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক দুর্গাপুর নগর নিগমের কাছে একটি তদন্ত রিপোর্ট চাওয়ার পরেও নগর নিগমের মুখ্য প্রশাসক অনিন্দিতা মুখার্জি পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত হলেন কেন? বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে অনিন্দিতা বলেন,”প্লিজ, এই ব্যাপারে আমাকে জড়াবেন না। আমি কিছুই বলতে পারবনা।” অর্থাৎ কবি দত্তের হোটেলের বেআইনি নির্মাণ নিয়ে তদন্ত আদৌ হচ্ছে কিনা বা সেই তদন্তের অগ্রগতিই বা কি তা নিয়ে মুখ খুলতে বারণ কি? মুখ্য প্রশাসক নিজেই ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছেন গুটিয়ে যাচ্ছেন কেন? কিসের ভয়? একটি সূত্র জানায় শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বহু নেতা-নেত্রীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নাকি ওই একটি ঠিকানাতেই জব্দ হয়ে বন্দী। কারণ রাজ্যের খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তার অজান্তে কয়েক দফায় কবি দত্তের বেআইনি ওই হোটেলে থেকেছেন,জেলার সেলিব্রেটি সাংসদ কীর্তি আজাদকেও কবি নিজের ঘরে রেখেছিলেন মাসের পর মাস। শাসক, বিরোধী দলের গুচ্ছ গুচ্ছ নেতার অবাধ আশ্রয় বেআইনি ওই হোটেলেই।

শুধু কি তাই? সিটি সেন্টার থেকে মুচিপাড়া পর্যন্ত যে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ চলছে তাতে বহু গাছ, দোকান, রেস্তোরাঁর সামনের অংশ উপড়ে নির্মূল করেলেও প্রভাবশালী কবি আর তার পাতানো ভাইদের হোটেল, দোকান ঘরের সামনে এসেই সেই সড়কের মোর ঘুরে যায় উল্টোপথে। কারণ যত বিতর্কই থাক না কেন, কবি দত্তের বেআইনি নির্মাণের ভরা ওই হোটেলটি বাঁচিয়ে তবেই নাকি কাজ এগোতে পারবে এ শহরের বুকে। প্রশাসনের কর্তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়, নির্মাণের নকশা বদলে তৈরি হয় আলাদা নীল নকশা। “তাইতো নেতা, বন্ধু থেকে রাস্তা সবার মোড় ঘুরে যায় কবির চৌদ্দিতে এলেই। আমরা কি করব? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে তৃণমূলটা করি আর তিনি তো ওনার ওই হোটেলেই বসবাস করেন আবার প্রশাসনিক সভায় সবার সামনেই বলে দিচ্ছেন কবি খুবই ভালো লোক। তাহলে?” – মন্তব্য এক হতাশ তৃণমূল কংগ্রেস নেতার। তার কথায়, “উনি ঠিক করবেন কে দলে থাকবে, কে বাদ যাবে, কে টিকিট পাবে, কার নাম কাটা যাবে। দলের কলকাতার এক ‘অবিশ্বাসী বিদ্যুৎ দাদা’র কল্যাণে সিপিএম আমলের সেই চারা কবি শাখা প্রশাখা বিস্তার করে এখন বৃক্ষ। হতে চাইছেন মহীরূহ। সেই কারণেই কি এডিডিএ’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ও সম্প্রতি কবির সাথে সমঝোতার পথে হেঁটেছেন? কবির সাথে নিজের এখন ‘গলায় গলায় কতটা যে ভাব’ সেই ছবি সপ্তাহখানেক আগে ফেসবুকে পোস্ট করে নিজের মুখ উজ্জ্বল করছেন বর্ষীয়ান তৃণমূল কংগ্রেস নেতা তাপস। অর্থাৎ এক কথায় – কবি প্রভাবশালী নিশ্চয়ই। এখন প্রশ্ন – চাকরি সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের মন্ত্রীকেও কোর্টের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয় প্রভাবশালী তকমা দিয়ে। যার অর্থ – যার বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতি বা বেআইনি কাজের অভিযোগ তিনি গরাদের বাইরে থাকলে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে, তাই গ্রেফতার করাটা জরুরি। কবি দত্তর হোটেলের বেআইনি নির্মাণ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজ্লাসে একটি মকদ্দমা চলছে। অভিযোগকারী দূর্গাপুর শহরেরই শান্তনু মিশ্র। তার অভিযোগ – কবি দত্তের সিটি সেন্টারের বিলাসবহুল হোটেল সিটি রেসিডেন্সি বেআইনি নির্মাণে ভরা। আপাদমস্তক বেআইনি নির্মাণের দরুন দু দফায় গুনাগার হিসেবে কবি দত্ত দুর্গাপুর নগর নিগমকে প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়েছেন আবার গত ২০২০র ৫ই ডিসেম্বর একটি মুচলেখা জমা দিয়ে নগর নিগমের মেয়রের কাছে জরিমানা কম করার আবদার করেছেন তিনিই। নির্মাণ স্বচ্ছ ও আইনসিদ্ধ হলে কিসের জরিমানা? জোচ্চুরি নির্মাণের দেড় দশক পর জরিমানা দিয়ে কবি আদতে কবুলই করে নিয়েছেন – তিনি সরকারকে ঠকিয়ে, পুরকর ফাঁকি দিয়ে বহু বছর নিশ্চিন্তে ফায়দা লুটে এসে এখন ‘সাধু সাজতে ‘ চাইছেন। জরিমানা দেওয়ার পর জবরদখল বা বেআইনি নির্মাণ বহাল রাখাটা কি আইনসিদ্ধ?

আবার, অন্য যুক্তিতে – গায়ের জোরে জরিমানা করা হলে আইনের পথে না হেঁটে কবি তবে জরিমানা লঘু করার আবেদন করলেন কেন?

এবার দেখা যাক জরিমানার বহর:

২০২০ র ২৬ শে নভেম্বর দুর্গাপুর নগর নিগম কবি দত্তের সংস্থাকে প্রায় ১৯.২৯ লক্ষ টাকার একটি ডিমান্ড নোটিশ পাঠায় হোটেলের ফ্লোর এরিয়া সংক্রান্ত গরমিলের দরুন। তারও আগে ২০১৭ সালের ২৫শে মে কবি দত্তের সংস্থাকে পাঠানো প্রথম ডিমান্ড নোটিসের পরিপ্রেক্ষিতে তার সংস্থা ৫৪.০৬ লক্ষ টাকা গুনাগার দিতে বাধ্য হয় নগর নিগমকে। মজার কথা হলো সিটি রেসিডেন্সি হোটেলের ঘড় মিলের গুনাগার দিচ্ছে ভিডিও প্লাজা নামের অন্য একটি সংস্থা। একি উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে? এই ৫৪.০৬ লক্ষ টাকা নগর নিগম নিগমের সচিব জরিমানা বাবদ ডিমান্ট নোটিশ পাঠিয়ে ছিলেন ২০১৭ এর ৯ই মার্চ। ওই টাকা জমা করার পর প্রভাবশালী কবি ১০ই মে ২০১৯ নগর নিগমের কমিশনারের কাছে একটি আকুপেন্সি সার্টিফিকেট এর জন্য দরবার করেন।

এদিকে, হোটেল ব্যবসায়ী কবি দত্তকে আচমকাই আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যানের পদে বসিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুরের একটি প্রশাসনিক সভায়। কবির যেন হঠাৎই ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’ হয়ে যাওয়ার বেজায় অস্বস্তিতে পড়েন সংস্থার চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। কবি দত্তের চেম্বারে তার পোষ্য দু চার জন পেয়াদা – যাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া এক চিটফান্ড কারবারি ছাড়াও বেশ কয়েকজনকে দেখা যেত। তাপস তখন ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ কবিকে নিয়ে বেশ বিরক্তই ছিলেন। সেই কবিই ফের বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন সটান বর্ষিত হলেন এডিডিএ’র চেয়ারম্যানের পদে। তার অল্প দিন আগেই অবশ্য এক রহস্যজনক বিধ্বংসী আগুনে ছারখার হয়ে যায় এডিডিএর মূল প্রশাসনিক ভবন। কি করে লাগলো সব নথি ছারখার করা ওই আগুন – তার হদিস নগরবাসী ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই তাপসের চেম্বারে বিনা মেঘের বজ্রপাত! সেই থেকে প্রায় মুখ দেখা দেখি বন্ধ কবির সাথে। কয়েক মাস পর যেচেই সম্পর্ক ঠিক করে নিলেন বর্ষিয়ান তৃণমূল নেতা তাপস।

কবির হোটেলের বেআইনি নির্মাণ নিয়ে দুর্গাপুর নগর নিগম কার্যত যে নম: নম: করেই তদন্ত করছে তা প্রমাণও মিলতে শুরু করেছে ইদানিং। এখন দেখা যাক কেমন সেই আহ্লাদে ভরা তদন্ত?

তদন্ত করছেন বাবলু বিশি। ইনি হচ্ছেন নগর নিগমের বিল্ডিং প্ল্যান বিভাগের নাকি ভারপ্রাপ্ত একজন ইনচার্জ। যদিও ইনি একজন সাধারণ কেরানি মাত্র, যিনি কবির সাথে তার গদগদ সম্পর্কের রসায়ন স্বেচ্ছায় ফেসবুকে আপলোড করে ঢালাও সার্টিফিকেট দিয়েছেন তার দাদাকে। ভাবা যায় – অনুগত এই কেরানীই আবার তদন্ত করছেন তার অভিযুক্ত দাদার তথাকথিত কুকীর্তির! তার সেই তদন্তের নিট ফল তবে কি হতে পারে – তা সহজেই অনুমেয়। মোকদ্দমার অভিযোগকারী শান্তনু মিশ্রের অভিযোগ, “চামচা বেলচাদের দিয়ে তদন্ত করলে সেই রকম রিপোর্ট তো হবে ফর্মাইসি। এটা আদালতে জানাবো। জানাবো কমিশনার কেনই বা এমন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার তদন্ত করছেন বাবলুকে দিয়ে? ওই বাবলুর বিরুদ্ধে তো এমনিতেই অনেক অভিযোগ, তাহলে কি অমৃতা সিনহার মত একজন দায়িত্বশীল বিচারপতির নির্দেশ নিয়ে শ্রেফ ছেলে খেলা করলো নগর নিগম বা এডিডিএ? প্রভাবশালী কবির পিঠ বাঁচাতে কি এই ব্যবস্থা? ভেতরের রহস্য শেষে কোর্টেই উন্মুক্ত হবে।” একের পর এক কাছা খুলতে হবে কোর্টেই – এ দাবি সান্তনু মিশ্রের। কবি দত্তের বিতর্কিত ওই হোটেলের বেআইনি নির্মাণের মৌচাকে পাকাপোক্ত ঢিলটি মারেন প্রাক্তন মেয়র দিলীপ আগস্তি। কবিকে জরিমানা, মুচলেখা দিতে হয় এই ‘আয়রন ম্যান’ অগস্থির যাঁতাকলে পড়েই। সেই অগস্তি হাইকোর্টের মোকদ্দমার পর এদিন বলেন, “আমি পদে বসে শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এতটা তো করাই কর্তব্য।”

এদিকে, মোকদ্দমাকারী মিশ্রর কথায়, “হোটেলটিতো আর পালাচ্ছেনা। জায়গাটাও এখনই কেউ কেড়ে নিচ্ছেনা। কিন্তু, প্রভাবশালীর কবির উপস্থিতিতে তদন্ত হলে তা কি কখনো নিরপেক্ষ হতে পারে? প্রভাবশালীদের অন্যএ সরিয়ে রেখে বা আটকে রেখেই এইসব তদন্ত করা উচিত। আবার, ওই প্রভাবশালীর পেয়াদাদের দিয়ে তদন্ত করলে তো রিপোর্ট সেই রকমই হবে। তাই আদালতের তত্ত্বাবধানে আলাদা করে তদন্ত কমিটি করে বিস্তারিত তদন্ত করলেই আসল অপরাধ উদঘটিত হবে, না হলে এমন আইওয়াশ রিপোর্টিং আসবে।” এ প্রসঙ্গে বাবলু বিশি যা বলেন, তাতে মিশ্রর আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিশি বলেন, “না না। ওই হোটেলে তো নির্মাণের কোন গোলমাল নেই সব তো ঠিকই আছে বলেই আমাদের তদন্তে বোঝা যাচ্ছে।”

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments