eaibanglai
Homeএই বাংলায়শিল্পীর স্মরণসভা, অনুগামীদের চোখ দিয়ে ঝরল জল

শিল্পীর স্মরণসভা, অনুগামীদের চোখ দিয়ে ঝরল জল

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, গুসকরা, পূর্ব বর্ধমান-: আসার সময় হলেও তখনও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক প্রবেশ করেননি। ওদিকে বন্ধুরা বেঞ্চ বাজিয়ে চলেছে। বোঝাই যাচ্ছিল তাদের মধ্যে কেউ হয়তো গান করবে। তখন এটাই ছিল অলিখিত রেওয়াজ। সুযোগ পেলেই সুরে-বেসুরে একক বা কোরাস সঙ্গীতে মেতে উঠত ছাত্রছাত্রীরা। সেটাকে সঙ্গীত না বলে চিৎকার বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ছিপছিপে এক স্বল্পভাষী যুবক একের পর এক গান করে চলেছে – ‘ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন?’ কখন যে শ্রেণিকক্ষের দরজায় শিক্ষক এসে দাঁড়িয়েছেন সেটা কারও খেয়াল নাই। তারা তখন বন্ধুর গানে মুগ্ধ। ওদেরই বা কী দোষ, স্বয়ং শিক্ষক নিজেই ছাত্রের গানে এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়লেন যে কোনোরকম বিঘ্ন না ঘটিয়ে চুপ করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। সেদিন তিনি ক্লাস নিতেই ভুলে গেলেন। তবে ঘটনাটি কেবল একদিন নয়, মাঝেমাঝেই ঘটত। অনেক সময় সঙ্গীতপ্রেমী শিক্ষকরা প্রিয় ছাত্রের গান শোনার জন্য লুকিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেদিনের এই যুবকটি হলো চিন্ময় দে, সবার চিনুদা। অনেকেই তাকে আর এক ভূপেন হাজারিকা বলে সম্বোধন করতে শুরু করে।

সেইসময় কিশোর কণ্ঠী, লতা কণ্ঠী ইত্যাদি কণ্ঠীদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল। যেকোনো সঙ্গীতের মঞ্চে তাদের দাপট দেখা যেত। ভূপেন হাজারিকা ‘কণ্ঠী’ হিসাবে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী চিন্ময় কিন্তু নিজেকে নিছক ‘কণ্ঠী’র মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলেন। অন্যান্য সঙ্গীতেও নিজেকে পারদর্শী করে তোলেন। দূরদর্শনের কীবোর্ড শিল্পী হিসাবেও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। গুসকরা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সঙ্গীত শিক্ষক হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। এলাকায় সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে যারা পরিচিতি লাভ করেছেন তাদের একটা বড় অংশ তার ছাত্রছাত্রী। এইভাবে একটা বিস্তীর্ণ এলাকায় সঙ্গীত শিক্ষক ও শিল্পী হিসাবে চিন্ময় দে হয়ে ওঠেন সবার চিনুদা। সংসারে অভাব থাকলেও সঙ্গীত হয়ে ওঠে তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচটা গড় বাঙালির মত চিন্ময় বাবু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। ধীরে ধীরে দৃষ্টি শক্তিও ক্ষীণ হতে থাকে। নিয়মিত চিকিৎসা চলত। চোখের জন্য কিছুটা পরনির্ভরশীল হলেও চিন্ময় বাবু সঙ্গীতকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত তিনি মৃত্যুর কাছে হার মানতে বাধ্য হন- ‘তুমি রবে নীরবে’। আর কোনোদিনও শোনা যাবেনা ‘আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমাকে আপন করেছে আপন হয়েছে পর।’

তার পার্থিব দেহ হার মানলেও পেছনে রেখে গেলেন স্ত্রী আলো দে, একমাত্র কন্যা শতাক্ষী সহ অসংখ্য গুণগ্রাহীকে। আর রেখে গেলেন তার প্রিয় সঙ্গীতের যন্ত্রপাতিকে। ‘বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের- হাহাকার শুনেও, নিঃশব্দে নীরবে…’ চিন্ময় দে থেকে যাবেন সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে।

এটা যে চরম সত্যি তারই প্রমাণ পাওয়া গেল। সম্প্রতি ‘শিল্পী সমাজ’ এর উদ্যোগে গুসকরা বিদ্যাসাগর হলে আয়োজিত হয় প্রয়াত শিল্পীর স্মরণসভা। প্রচারের অন্তরালে থাকতে চাওয়া মানুষটির স্মরণসভায় হাজির হন তার ছাত্রছাত্রী সহ অসংখ্য সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেউই নিজেদের চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি, অনেকেই মাঝপথে থেমে যান। যতটা সম্মান পাওয়া উচিত ছিল চিন্ময় সেটা না পাওয়ার জন্য অনেকের মধ্যে আক্ষেপ দেখা যায়।

বাবার সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাননি শতাক্ষী ওরফে বাবার আদরের মুনমুন। চোখ দিয়ে শুধুই জল গড়িয়ে পড়ে। অস্ফুটে একটা কথায় শোনা যায় – বাবার সম্পর্কে এত জ্ঞানীগুণী মানুষের প্রতিক্রিয়ার পর কিছু বলা সাজেনা।


RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments