জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, পূর্ব বর্ধমান-: প্রত্যেক বাঙালি যেন কাব্য প্রতিভাকে সঙ্গে করে জন্মগ্রহণ করেন। দেখলে মনে হবে কাব্য লগ্নে তার জন্ম। জন্মসূত্রেই সে একজন কবি। যেকোনো মুহূর্তে, বয়স কোনো ফ্যাক্টর নয়, তার কলম থেকে বের হয় ছোট্ট একটা কবিতা। মুখে মুখে বলে ফেলতে পারেন একটা ছড়া। বর্ধমান শহরের রাণা চ্যাটার্জ্জীও ব্যতিক্রম নন। অল্প বয়সেই তার কলম থেকে বের হয় ব্যাঙ্গাত্মক ছড়া, ‘গ্রামের এক ডাক্তার /তাকে নিয়ে ফ্যাক্টর…’। তখন তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। কবি হিসাবে সেই শুরু।
রাণার অবশ্য একটা বাড়তি সুবিধা ছিল। ছোট থেকেই সাহিত্যের পরিবেশে বড় হয়েছেন। পাশে পেয়েছেন জামাইবাবু সুপ্রিয় ব্যানার্জ্জী ও দাদা রাজা চ্যাটার্জ্জীকে। দু’জনেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। পারিবারিক ‘জ্ঞানোদয়’ ও ‘সুজলাং’ পত্রিকায় মাঝে মাঝে তার কবিতা প্রকাশিত হতো। ফলে তার মধ্যে আলাদা একটা উত্তেজনা কাজ করত। খাতার মলাট, ক্যালেন্ডারের পেছনে নানা ছড়া, আঁকিবুকি সেটার সাক্ষ্য বহন করত।
সেখানে ফুটে উঠত ছড়া, ছন্দ, কার্টুন, হাতের কাজের নমুনা। তখন রাণা অবশ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বিষয়টি শিশুসুলভ হিসাবে গণ্য করা হলেও একটু একটু করে উঁচু ক্লাসে ওঠার সাথে সাথে তার লেখার সংখ্যা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি সেগুলো যথেষ্ট উন্নত মানের হয় এবং নানান পত্র পত্রিকায় সেগুলি নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। এভাবেই অল্প বয়সেই রাণা শহরের কাব্যরসিক পাঠকদের প্রশংসা আদায় করে নেন।
মধ্যবিত্ত পরিবারের বাঙালি মা-বাবার একটাই স্বপ্ন থাকে তার সন্তান যেন ভাল করে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বরাবরের মেধাবী ছাত্র রাণা স্কুল জীবনে প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছেন। ফলে পড়াশোনার পাশাপাশি কাব্যচর্চার জন্যে সে মা-বাবার উৎসাহ পেয়ে এসেছে।
সমাজ বিদ্যায় এম এ করার সুবাদে মাটির পৃথিবী থেকে উঠে আসা চরিত্র তার কাব্যের মধ্যে স্থান পেয়েছে। চাকরি সূত্রে দিল্লী, আগ্রা, বেনারস প্রভৃতি এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। বর্তমানে লালমাটির বীরভূমে এসে অভিজ্ঞতায় তিনি আরও সমৃদ্ধ হয়েছেন। বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে গড়ে ওঠা চরিত্রগুলোকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি তার গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, কার্টুন, ছড়া ইত্যাদিতে স্থান দিয়েছেন। ফলে পাঠকও তার কাব্যের মধ্যে ভিন্ন স্বাদ পেয়েছেন।
শুধু এই দেশে নয়, দেশের বাইরেও একাধিক পত্র-পত্রিকায় রাণার লেখা কবিতা স্থান পাওয়ার পাশাপাশি উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ই-ম্যাগাজিন ও সমাজ মাধ্যমেও তার লেখা কবিতার স্বাদ আস্বাদন করার সুযোগ পান কাব্য রসিক পাঠক।
এছাড়াও রয়েছে নিজস্ব কবিতা পেজ ‘উড়ো মেঘ’। যেখানে প্রকাশিত কবির লেখা কবিতাগুলি বিভিন্ন বাচিক শিল্পীর কণ্ঠে মুখরিত হয়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার অর্জন কবির অন্যতম সেরা পছন্দ যা এনে দিয়েছে একের পর এক সম্মাননা।
তবে রাণার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হলো যখন তিনি ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠুক কবিতার মুখ’ শীর্ষক সংকলনে কবিতা প্রতিযোগিতায় বিশেষ সম্মান লাভ করেন। এই ঘটনাটি তার বিদ্যালয় জীবনে ঘটেছিল এবং রামকৃষ্ণ মঠের পত্রিকা ‘শ্রীমা’ সহ ৫ টি দেশের কবি-সাহিত্যিকরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। রাণার ভাষায় – ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক সম্মান পাব, কিন্তু কোনোদিনই এই প্রাপ্তিকে ভুলতে পারবনা।
তবে শুধু কবিতা লেখা নয়, সম্পাদনার ক্ষেত্রেও রাণা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তার সম্পাদিত প্রায় হাফ ডজন একক পাঠক মহলে প্রশংসিত হয়েছে। নতুন প্রতিভাদের পাশে থাকার জন্য সাহিত্য অনুরাগী পারমিতা রাহা হালদারের সঙ্গে যৌথভাবে ‘দূর্বাদল সাহিত্য প্রকাশনী’ তৈরি করেছেন।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন নীরব সমাজসেবী। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সর্বদা দুঃস্থ ও পীড়িতদের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। অবসর পেলেই মানুষের মন নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। খোঁজার চেষ্টা করেন তাদের প্রতিভার।
প্রতিভা এবং সারল্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বর্ধমানের রাণা ইতিমধ্যে নিজেকে উঠতি কবিদের কাছে নিজেকে আদর্শ হিসাবে গড়ে ফেলেছেন।





