জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- একটা সময় কলকারখানার মালিকদের নীতি ছিল – কাজ বেশি, বেতন কম। প্রতিদিন শ্রমিকদের একটানা ১০-১২ ঘণ্টা ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করতে ও সপ্তাহে ছ’দিন কাজ করতে বাধ্য করা হতো। বিনিময়ে বেতন জুটত সামান্য। এদিকে কাজের কোনো স্থায়িত্ব ছিলনা, ইচ্ছেমত ছাঁটাই করা হতো। অত্যাচার সহ্য সীমার বাইরে চলে গেলে ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর পুলিশ গুলি চালায়। ফলে একাধিক শ্রমিক নিহত হয়।
এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শ্রমিক সংগঠনগুলি ১ লা মে দিনটিতে কাজ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সরকারি ভাবে ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি তোলে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি সরকারিভাবে মেনে নেওয়া হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১ লা মে দিনটি আন্তর্জাতিক ‘শ্রমিক দিবস’ বা ‘মে দিবস’ পালিত হতে থাকে। ভারতে প্রথম ১৯২৩ সালে ‘মে দিবস’ পালিত হয়। বিগত কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধীরে ধীরে পুঁজিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। কর্পোরেট সেক্টরগুলোর মূল লক্ষ্য আরও বেশি মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি শ্রমিক শোষণ। অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন জায়গায় নাকি অন্যভাবে একটানা ১০-১২ ঘণ্টা করে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিনিময়ে বেতন কিন্তু ঠিকমত পাওয়া যাচ্ছেনা। সম্প্রতি কোনো কোনো মালিকপক্ষ আবার আরও বেশি সময় ধরে শ্রমিকদের কাজ করার নিদান দিচ্ছে। সম্ভব হলে তারা শ্রমিকদের সপ্তাহে ১৬৮ ঘণ্টা কাজ করিয়ে নিত! তাদের বক্তব্যের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে আবার অতীতের কালোদিন অর্থাৎ দাসপ্রথা ফিরে আসার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যেভাবে বিভিন্ন দেশের সরকার এদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে তাতে হয়তো সেইদিন পুরোপুরি আসতে বেশি দেরি নাই!
এক্ষেত্রে আমাদের দেশের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর ভূমিকা যথেষ্ট সন্দেহজনক। ধীরে ধীরে সরকারগুলো সরকারি চাকরির দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে শাসক ও বিরোধীদের এক সুর শোনা যায়। একজায়গায় বিরোধী হিসাবে তারা যে দাবি করে অন্যত্র শাসক হিসাবে সেটাই করে। বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক পদ শূন্য থাকলেও সেগুলি পূরণ করার জন্য সদিচ্ছা কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছেনা। উল্টে কম বেতনে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করে তাদের দিয়ে বেশি পরিমাণ কাজ করিয়ে নিচ্ছে। চাকরি যাওয়ার ভয়ে এরাও চুপ করে থাকছে। বলা যেতেই পারে সরকারি স্তরেও শ্রমিকরা শোষিত হচ্ছে।
পরিস্থিতির জন্য সরকারি কর্মচারীদের একাংশ তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেনা। এদের একটাই লক্ষ্য, ঠিকমত কাজ করবনা কিন্তু নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি সহ সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধার দাবি তুলব। এদের আচরণ দেখলে মনে হবে ভবিষ্যত প্রজন্ম সম্পর্কে এদের কোনো ভাবনা নাই। সরকারের যে দেওয়ার একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে সেটা মানতে চাইনা। শুধু তাই নয় সাধারণের কাজ করে দেওয়ার জন্য এদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ারও অভিযোগ ওঠে। শাসকদল ঘেঁষা শ্রমিক সংগঠনের ভূমিকা বেশি সন্দেহজনক হলেও অন্যরা কিন্তু খুব একটা পেছিয়ে নাই। দাবি আদায়ের জন্য এরা যতটা সক্রিয় হয় সংস্থার প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য সংগঠনের সদস্যদের সক্রিয় করে তোলার জন্য এদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়না। সমস্ত শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য একসুরে এদের দাবি তুলতে দেখা যায়না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক নেতা আক্ষেপ করে বললেন- সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষ প্রত্যেকেই যদি সচেতন নাহয় আগামীদিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, শ্রমিক শোষণ আরও বেড়ে যাবে। হয়তো ভবিষ্যতে গোটা বিশ্বজুড়ে শিকাগো শহরের মত আরও একটা আন্দোলন শুরু হবে।





