নিজস্ব সংবাদদাতা, দুর্গাপুর ও সিউড়ি:- এ যেন বলিউডের পর্দা ফাটিয়ে বাস্তবের মাটিতে দাপিয়ে বেড়ানো আসলি রিয়াল জগতের “মিস্টার নটবরলাল”। অভিনব কায়দায় প্রতারণা করে তিনি ইতিমধ্যেই রাজ্যজোড়া খ্যাতির চূড়ায়। কয়েক দশক আগে মারা গিয়েছেন তাজমহল বিক্রি করা আসল “নটবরলাল”, যাকে নিয়ে বলিউডে অমিতাভ বচ্চনের হিট ছবি ছিল মিস্টার নটবরলাল। কিন্তু, এখনো ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে এইরকম বহু “মিস্টার নটবরলাল” তাদের নতুন নতুন প্রতারণার কায়দার ভেল্কি দেখিয়ে যাচ্ছেন দৈনন্দিন। তেমনই এক “মিস্টার নটবরলালের” হদিস পাওয়া গেছে এবার দুর্গাপুরে।
দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বিধাননগর সংলগ্ন স্টিল পার্ক এলাকায় নাকি বাড়ি ওই “মিস্টার নটবরলালের”। জনসমক্ষে পারিবারিক একটি টাইলস মার্বেলের দোকান খুলে দুর্গাপুরের এই “মিস্টার নটবরলাল” দৈনন্দিন তার কুকীর্তির নতুন নতুন উদাহরণ শিল্পাঞ্চলের বুকে রেখে যাচ্ছেন। বহু বছর ধরেই নাকি এই “মিস্টার নটবরলাল” দুর্গাপুরে বসবাস করে। কখনো “মুখার্জি দা”, কখনো “সোনা দা”, কখনো “সোম দা” তো কখনো আবার “বড় কর্তা” নাম নিয়ে একের পর এক অপরাধ ও ষড়যন্ত্র মূলক কারবারের সাথে যুক্ত হয়েছেন এই দুর্গাপুরের “মিস্টার নটবরলাল”।
দুর্গাপুরের এই “মিস্টার নটবরলালের” খবর দুর্গাপুরে কর্মরত এক ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মর্যাদার আধিকারিক প্রথম জানতে পারেন। পুলিশের ওই সূত্র মারফত জানা গিয়েছিল – বিভিন্ন থানার ওসিদেরকে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের নাম করে এক ব্যক্তি দৈনন্দিন ব্ল্যাকমেল করছে “মুখার্জি দা” নাম করে। শুধু তাই নয়, নিচু তলার পুলিশ কর্মীদেরকে ভয় দেখিয়ে নিজেকে গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশের “বড় কর্তা” হিসেবে পরিচয় দিয়ে তাদের কাছ থেকে বহু অপরাধের নথি গায়েব করেছেন বলে অভিযোগ ছিল। শুধু পুলিশকেই নয়, এক সময় নাকি আসানসোল দুর্গাপুর এলাকার নামকরা বেশ কয়েকটি কোল মাফিয়াকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নাম করে কয়েক লক্ষ টাকা লুঠ করছেন তিনি, বলে অভিযোগ। অস্ত্র আইন সহ একাধিক ধারায় কয়েক মাস আগেই তাকে গ্রেফতার করেছিল আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের নিউ টাউনশিপ থানার পুলিশ। তারপর বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর, ফের এই “মিস্টার নটবরলাল” নতুন করে অপরাধ জগতে ফিরে আসে শিল্পাঞ্চল সহ পার্শ্ববর্তী জেলা গুলিতে।

শিল্পাঞ্চলের মানুষের কাছে তার ওই “মিস্টার নটবরলাল” ছবি প্রকাশ্যে আসতেই এবার তার পরিবার মুখ লুকাতে শুরু করে দুর্গাপুরে। জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে ওই “মিস্টার নটবরলাল” শিল্পাঞ্চলের গণ্ডিতে আর তার কুকর্ম না করে পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি জেলা ও অন্য রাজ্যে তার প্রতারণার অপরাধ জগতের ঢালাও বিস্তার করেছে। বহু মানুষ আবারো দুর্গাপুরের “মিস্টার নটবরলালের” অপরাধের শিকার হয়েছেন। দুর্গাপুরের “মিস্টার নটোবর লালের” নাম আবারো শিরোনামে এসেছে, কারণ সম্প্রতি ৫০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে এক অপহরণ কাণ্ডের চুড়ামনি যে তিনিই। গত তিন দিন আগে বীরভূম জেলার খয়রাসোল থানার পাঁচড়া এলাকায় ৫০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে সিনেমার কায়দায় এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করতে এসে পুলিশের তৎপরতায় ভেস্তে যায় ওই অপহরণকারীদের আসল পরিকল্পনা।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ জনের একটি অপহরণকারীদের দল একটি স্করপিও গাড়ি নিয়ে খয়রাসোল থানার পাঁচড়া এলাকা থেকে দুবরাজপুরের ব্যবসায়ী জয় সরকারকে অপহরণের চেষ্টা করে। পাঁচ জন মিলে ব্যবসায়ীকে গাড়িতে চাপানোর চেষ্টায় চলে ব্যাপক ধাক্কাধাক্কি। যা কিনা পুরোটাই সেখানে থাকা একটি সিসিটিভি ক্যামেরায় পরিষ্কার ধরা পড়ে। এ দৃশ্য দেখে অনেকেই হতবাক। স্থানীয় লোকজন সহ আক্রান্ত ব্যবসায়ীর স্ত্রী তনুশ্রী সরকার পুলিশকে দ্রুত খবর দেন – বেশ কয়েকজন অপরিচিত ব্যক্তি একজনকে টেনে গাড়িতে চাপানোর চেষ্টা করছে এবং তাদের ধ্বস্তাধ্বস্তি চলছে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্করপীও গাড়িটিতে জয়কে চাপিয়ে অপহরণকারীরা কয়েক কিলোমিটার রাস্তা এগিয়েও যায়। এদিকে পুলিশ ধাওয়া করে অপহরণকারীদের গাড়ি সহ তাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসে। এদিকে, ব্যবসায়ীর স্ত্রী অভিযোগ করেন, নগদে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা।

আটককৃতদের মধ্যে দুর্গাপুর এলাকার জনৈক দেবাশীষ ব্যানার্জি নিজেকে পুলিশ পরিচয় দেন। যার প্রেক্ষিতে খয়রাসোল থানার পুলিশকে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত ধৃতের পরিবারের সাথে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে – আদৌও তিনি পুলিশের লোকই নন। তখন বীরভূমের খয়রাশোল থানার পুলিশ দুর্গাপুরের বড় পুলিশকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারে – দীর্ঘদিন যাবৎ ফেরার এই “দুর্গাপুরের মিস্টার নটোবর লালের” কথা। পুলিশ সকলকেই গ্রেফতার করে। সেই সাথে স্কোরপিও গাড়ি, পাঁচটি মোবাইল, নাইলন দড়ি অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ আরো জানতে পারে, যে নটবরলালের দলের সাগরেদ রাহুল ঠাকুর ঝাড়খণ্ডের এবং জিয়াউল সেখ, গৌরাঙ্গ সরকার,সেখ ফিরোজ ও দেবাশীষ ব্যানার্জি পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। ধৃতদের দুবরাজপুর আদালতে তোলা হলে বিচারক তদন্তের স্বার্থে দুদিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন, বলে জানান দুবরাজপুর আদালতের সরকারী আইনজীবী রাজেন্দ্র প্রসাদ দে। এই ঘটনায় আরো কেউ জড়িত কিনা – তাও খতিয়ে দেখছে খয়রাশোল থানার পুলিশ।







