মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- পুকুর চুরির কথা অনেকেই শুনে থাকবেন তবে এবার দুর্গাপুরে ঘটে গেল আস্ত একটা জঙ্গল চুরির ঘটনা যা জেনে শিল্পাঞ্চলবাসি হতবাক। এমনই এক আজব ঘটনা ঘটেছে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে। রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদ, দুর্গাপুর নগর নিগম, রাজ্যের বনবিভাগ ও সর্বোপরি দুর্গাপুর মহকুমা শাসকের দপ্তরে কোন অভিযোগই বা খবরই নেই।

দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল নাকি একদিন গভীর জঙ্গলে ঘেরা জায়গা ছিল। আজও শিল্পাঞ্চলের বুকে রয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক টুকরো গভীর জঙ্গলের অবশিষ্ট অংশ। গভীর জঙ্গলের অবশিষ্ট অংশে প্রায় দিনই বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় জীবজন্তু দেখা মেলে। আজও শিল্পাঞ্চলের মানুষ গভীর অরণ্য দেখার জন্য এবিএল জঙ্গলে যান। এত জঙ্গল থাকার পরেও দুর্গাপুরের বায়ুদূষণের মাত্রা লাগামছাড়া। দেশের যে কয়েকটি বড় শহরে দূষণের মাত্রা লাল দাগ ছাড়িয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে আমাদের প্রাণের শহর দুর্গাপুরও। কিছুদিন আগেই রাজ্য সরকারের উদ্যোগে দুর্গাপুরের একটি বড় অংশে ‘নগরবন’ নামক এক বনাঞ্চল সৃষ্টির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যেই তার কাজ অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। রোপন করা হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েক হাজার ফলের ও ভেষজ ফল-ফুল ও বিভিন্ন দামি গাছপালা। ঘটা করেই প্রত্যেক বছর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একাধিক গাছ লাগিয়ে এই নগরবনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। কিন্তু একটি আস্ত পুকুর সহ প্রাচীন আট একর এর জঙ্গল হঠাৎই গায়েব হয়ে গেল দূর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বুক থেকে খবর রাখেনি দুর্গাপুরের কোন আধিকারিক।

সম্প্রতি দুর্গাপুরের এক দুর্গাপুরের সমাজকর্মী সুব্রত মল্লিক দেশের গ্রীন ট্রাইবুনালে একটি মামলা রুজু করেছে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে। ওই মামলাতে ইতিমধ্যেই উঠে এসেছে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য। আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের দখলে থাকা প্রায় ৮ একর জায়গা জুড়ে ছিল এক গভীর ও প্রাচীন জঙ্গল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই মাটি চাপা দিয়ে সেই জঙ্গল এখন গড়ের মাঠে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ। দুর্গাপুরের সমাজ কর্মী সুব্রত মল্লিক ওই মামলাতে অভিযোগ করেছেন দুর্গাপুর এ বি এল সংলগ্ন ‘এসপিএস স্টিল রোলিং মিল প্রাইভেট লিমিটেড’ নামক একটি কারখানা তার সামনে থাকা সামনে থাকা প্রায় ৮ একরের একটি বনাঞ্চলকে ধ্বংস করে দিয়েছেন সম্পূর্ণ রূপে। সরকারি নথিতে জ্বলজ্বল করছে যে ওই জায়গার আইনসিদ্ধ ও নথিভুক্ত মালিক আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদ। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল আট একর এর ওপর থাকা একটা আস্ত জঙ্গল গড়ের মাঠে পরিণত হল আর আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের কর্তা ব্যক্তিরা নাখে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন আজও। আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের সাথে সাথে দুর্গাপুর নগর নিগম, দুর্গাপুর প্রশাসন, রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও সর্বোপরি রাজ্য বন বিভাগ কেওই এ বিষয়ে এখন অব্দি তেমন করে এই আট একরের জঙ্গল বিলুপ্ত হয়ে গেল কি করে তার বিষয়ে কোনো তদন্ত করে শুরু করেনি।


সরকারি বনাঞ্চল তাহলে কি এই ভাবেই লুট করবে শিল্পপতিরা? আর মানুষ শ্বাস কষ্ট, হৃদরোগের ভোগে শেষ হয়ে যাবে শিল্পাঞ্চলে? সেটা কি করে মেনে নি? তাই মামলা করেছি বললেন সুব্রত মল্লিক। তিনি অভিযোগ করেন “‘এসপিএস স্টিল রোলিং মিল প্রাইভেট লিমিটেড’ নামক কারখানাটি কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় পরিবেশ দপ্তর থেকে ছাড়পত্র পেয়ে ওই কারখানার উৎপাদন শুরু করে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই কারখানার বর্জ্য পদার্থ ও বাইরে থেকে নিয়ে আসা মাটি দিয়ে ধীরে ধীরে একটি ৮ একরের আস্ত প্রাচীন জঙ্গলকে গড়ের মাঠে পরিণত করেছে।” সুব্রত বাবু এদিন আক্ষেপের সুরে বলেন, “রাজ্য সরকারের এতগুলো দপ্তর কি করে চোখ বন্ধ করে এইরকম অনাচার সহ্য করছেন জানিনা। বহুবার বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ জানিয়ে লাভ না হওয়ার ফলে এখন আমি কেন্দ্রীয় গ্রিন ট্রাইবুনালে মামলা করেছি নিজের উদ্যোগে। আমার একটাই উদ্দেশ্য রাজ্য সরকারের বনাঞ্চল এইভাবে শেষ হওয়ার পেছনে কে বা কারা ইন্ধন জুগিয়েছে ওই কারখানা মালিকপক্ষকে তা অবিলম্বে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সাথে সাথে রাজ্য সরকারের দপ্তর গুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে যাতে ভবিষ্যতে আর কোনভাবেই সরকারি বনাঞ্চল এইভাবে লুপ্ত না হয়ে যায় সেদিকে কড়া নজর দিতে হবে।”

দুর্গাপুরের সমাজকর্মী সুব্রত মল্লিকের অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুনালের বিচারপতি মাননীয় বি অমিত সালকার ও মাননীয় জুডিশিয়াল মেম্বার অরুণ কুমার বার্মা গত ১৭/৭/২০২৫ তারিখে তাদের আদেশ নামায় উক্ত কারখানার ‘এসপিএস স্টিল রোলিং মিল প্রাইভেট লিমিটেড’ বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করেছেন এবং আগামী ২৯/৮/২০২৫ তারিখের শুনানিতে হাজির হতে জানিয়েছেন।

প্রশ্ন হল যখন আদালতের পক্ষ থেকে আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদ, রাজ্য বনবিভাগ, রাজ্য ভূমি ও ভূমি সংরক্ষণ দপ্তর, স্থানীয় এনটিপিএস থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ও সর্বোপরি রাজ্য প্রশাসনের সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটকে এই মর্মে নোটিশ করার পরেও কেন এইসব দপ্তর গুলি মুখে কুলুপ কেটে বসে আছে? তাহলে কি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে রাজ্য সরকারের এই দপ্তরগুলি সাথে ওই কারখানা কর্তৃপক্ষের কোন গোপন আঁতাত রয়েছে যার ফলে একটা প্রাচীন ৮ একরের আস্ত জঙ্গল গড়ের মাঠে পরিণত হয়েছে? এই নিয়েই এখন জোর চর্চা শিল্পাঞ্চলে।






