eaibanglai
Homeএই বাংলায়মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের পরিবারে কোজাগরীতে লক্ষ্মীপুজো হতো তন্ত্রমতে

মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের পরিবারে কোজাগরীতে লক্ষ্মীপুজো হতো তন্ত্রমতে

এই বাংলায় ওয়েব ডেস্কঃ- ব্রাহ্মসমাজীদের তখন পৈতে রাখায় ঘোর আপত্তি। তাঁর কাছেও এল পৈতে ত্যাগের নির্দেশ। কিন্তু পৈতে ত্যাগে রাজি হলেন না নগেন্দ্রনাথ। কারণ নগেন্দ্রনাথের কাছে পরব্রহ্মই সূত্র আর তাঁর দ্যোতক যজ্ঞোপবীত। এই নগেন্দ্রনাথই পরবর্তীকালে হয়ে উঠলেন ভাদুড়ী মহাশয় – পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ। কোজাগরীতে তাঁর পরিবারেরই দেবী লক্ষ্মীর তন্ত্র মতে আরাধনার ব্যতিক্রমী ধারার কথা শোনালেন ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

স্বগ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করে পাঠদানের ব্যবস্থা করা, কলকাতায় পেট্রিয়টিক ইনস্টিটিউশন নামে একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করা, ছাত্রদের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য বাংলা পদ্যে ‘প্রতিজ্ঞা শতক’ রচনা তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি। বাস্তবে, নিজের কালের বৃত্তে নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী তাঁর এইসব কর্মকাণ্ডের আলোতেই এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।

কাশীর সুমেরু মঠাধীশ শংকরাচার্য প্রমুখ ধর্মপ্রচারকরা তাঁকে ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। স্বীকার করে নেন পরমহংস হিসেবে। যোগ ভক্তি মার্গের সিদ্ধ সাধক হিসেবে সারা পৃথিবীতে তাঁর পরিচিতি “The Levitating Saint “- রূপে। পরমহংস যোগানন্দ ও সনন্দলাল ঘোষের লিখিত গ্রন্থে লঘিমাসিদ্ধ যোগী হিসেবে তাঁর শূন্যে ভেসে থাকার অলৌকিক ক্ষমতার বর্ণনা আছে।

এই ভাদুড়ী মহাশয় অর্থাৎ পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল হাওড়ার পায়রাটুঙ্গীর এক সম্পন্ন জমিদার পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ছিল পার্বতীচরণ ভাদুড়ী। মাতা ছিলেন ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী। এঁরা ছিলেন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। এই ভাদুড়ী বংশেরই সন্তান ছিলেন উদয়নাচার্য ভাদুড়ী, রাজা গণেশ।

এই ভাদুড়ী পরিবার ছিল অর্থে আর বিদ্যায় দেবী লক্ষ্মী এবং দেবী সরস্বতীর কৃপাধন্য। বিভিন্ন শাস্ত্রে এঁদের যেমন ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য তেমনই ছিল প্রগাঢ় ভক্তি।

এদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ ছিল নিত্য শাস্ত্র পাঠ, নিত্য পুজো। তবে বিশেষ বিশেষ পুজোর ক্ষেত্রে পুজোর দায়িত্ব পালন করতেন সাঁতরাগাছির কুল -পুরোহিতরা। তা সে চণ্ডী পুজো, কালীপুজো – যাইহোক। এ পরিবারে পুজোর ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতো তন্ত্রোক্ত বিধি। কিন্তু এই পরিবারে প্রতিদিন নাম কীর্তন হতো। প্রবাহিত হতো মহাভাবের স্রোত। তারপর হতো -” নারায়ণপরা বেদা নারায়ণপরাক্ষরা। নারায়ণপরা গতিঃ নারায়ণপরা মুক্তিঃ।।”
-এটাই ছিল এই পরিবারে চলে আসা প্রথা।

মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের ভাদুড়ী পরিবারে নিত্য লক্ষ্মী পুজো হতো। শালগ্রাম শিলার সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীর যে নিত্য পুজো – তা মূলত করতেন পরিবারের সদস্যরাই। আর স্ত্রী আচারে দেবী লক্ষ্মীর পুজোও ছিল। এরই সাথে ছিল চৈত্র, ভাদ্র এবং পৌষ মাসে কাটার লক্ষ্মীর পুজো।

কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোতে পুজোর দায়িত্ব পালন করতেন কুল পুরোহিতরাই। কোজাগরীতে কাটার লক্ষ্মীতেই পুজো হতো প্রাচীন পুঁথি মেনে তন্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে। এর সঙ্গে যেসব গুপ্ত বিষয় সংযুক্ত ছিল – তার ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করতেন কুল পুরোহিতরাই।

পুজোর সংকল্প হতো গৃহের সবচেয়ে বয়স্ক সধবা গৃহলক্ষ্মীর নামে। দেবীর পুজোতে ব্যবহার করা হতো সাদা ফুল। পদ্ম হিসেবেও প্রদান করা হতো শ্বেত পদ্ম। দেবীকে যেসব মিষ্টান্ন দেওয়া হতো – সেগুলি সবই তৈরি হতো ভেজে। ভাদুড়ী পরিবারের সধবা গৃহলক্ষ্মীরাই সেসব নিজেরা তৈরি করতেন।

এই পরিবারের কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোতে একটি বিশেষ নিয়ম ছিল সধবা গৃহলক্ষীদের রাত্রি জাগরণের। এঁদের মধ্যে যাঁর নামে পুজোর সংকল্প হতো, তিনি সারা রাত্রি জেগে থাকতেন পূজা গৃহের দরজায় – দরজা আটকে। এর উদ্দেশ্য ছিল – দেবীর আরাধনার পর যাতে দেবী গৃহ ত্যাগ করতে না পারেন। বলা বাহুল্য, এই রীতি পালন করেছিলেন পরম্পরাগতভাবে নগেন্দ্রনাথের ঠাকুমা এবং তাঁর মা ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীও।

মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ ছিলেন যোগমার্গের সিদ্ধ সাধক। বাল্যকালেই তিনি হঠযোগ এবং রাজযোগের প্রাণায়ামাদিতে সিদ্ধি লাভ করেন। কিন্তু নামে তাঁর রুচি ছিল প্রবল। নামের সঙ্গে সংযুক্ত হলে তাঁর মধ্যে নানা সাত্ত্বিক লক্ষণ প্রকাশিত হতো। বলা হয় – তাঁকে যোগশিক্ষা প্রদান করেছিলেন স্বয়ং নারায়ণ। বাস্তবে, সাধনায় সিদ্ধ নগেন্দ্রনাথ সর্বত্র, সর্বাবস্থায়, সর্বদিকে তাঁর হরিকে দেখতে পেতেন। তাঁর রচিত সাধন সংগীত – পরমার্থ সংগীতের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তার প্রমাণ।

শোনা যায় – তাঁর শেষ জীবনের সাধনভূমি কলকাতার রামমোহন রায় রোডের নগেন্দ্র মঠে অবস্থানকালীন সময়ে ভক্ত-শিষ্যদের অনুরোধে তিনি একবার হরিপ্রিয়ারও আরাধনা করেন। সেদিন তিনি যোগ বলে সৃষ্টিরূপিণীর সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলেন সৃজনী শক্তির প্রতীক পদ্মকে। পুরাণে তো বলাই হয়েছে।
“তস্মিন্ পদ্মে ভগবতী সাক্ষাৎ শ্রীনিত্যমেব হি।
লক্ষ্ম্যাস্তত্র সদা বাসো মূর্তিমত্যা ন সংশয়।।”

তথ্য ঝণ : অশোক ভট্টাচার্য।
চিত্র ঋণ : শ্রীশ্রীনগেন্দ্র মঠ এবং নগেন্দ্র মিশন, কলকাতা।

( লেখক সম্পর্কে মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের প্রপৌত্রীর পুত্র। )

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments