eaibanglai
Homeএই বাংলায়আজ ৮ ডিসেম্বর, এই দিনেই ঘটেছিল ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের প্রসিদ্ধ "অলিন্দ যুদ্ধ"

আজ ৮ ডিসেম্বর, এই দিনেই ঘটেছিল ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের প্রসিদ্ধ “অলিন্দ যুদ্ধ”

এই বাংলায় ওয়েব পোর্টালঃ- ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর,বেলা বারোটা। মহাকরণ তথা রাইটার্স বিল্ডিংয়ের একটি কামরায় বসে নিজের কাজকর্ম পরিচালনা করছেন কারাবিভাগের প্রধান ইংরেজ অফিসার কর্নেল সিম্পসন( যিনি স্বদেশী আন্দোলনের জন্য গ্রেফতার হওয়া বিপ্লবী তথা বন্দীদের উপর অত্যাচার করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন)। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন ব্যক্তিগত সহকারী জ্ঞানগুহ। জানা গেল, তিনজন বিলাতি পোশাক পরিহিত বাঙালি যুবক কর্নেল সিম্পসনের সাক্ষাৎ পেতে চান। এরই মধ্যে ওই তিন যুবক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন কামড়ায়। মুখ তুলে চাইলেন কর্নেল। এবং যা তিনি দেখতে পেলেন, তার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলেন না। তিন বাঙালি যুবক দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে, তারই দিকে রিভলবার তাক করে। তাদের মধ্যে একজন (বিনয়) ইংরেজিতে বললেন, “Pray to God, Colonel. Your last hour has come!” আচমকাই তিনটি রিভলবার থেকে বের হওয়া ছয়টি বুলেট তার শরীর ভেদ করল। চোখের নিমেষে কর্নেলের নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই মহাকরণ ভবনের অলিন্দে নিরাপত্তারক্ষী ও কমিশনার টেগার্টের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবী-ত্রয়ীর (বিনয়, বাদল, দীনেশ) সংঘর্ষ ইতিহাসে “অলিন্দ যুদ্ধ” বা “ব্যাটল অফ দা বারান্দা” নামে প্রসিদ্ধ। সংঘর্ষের শেষে গ্রেফতারি এড়াতে বাদল গুপ্ত সেখানেই আত্মহত্যা করেন, বিনয় হাসপাতালে মারা যান ও দীনেশের ফাঁসি হয়। ১৯৩০সালের ৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ আজকেই দিনেই ঘটেছিল ঐতিহাসিক এই ঘটনা, যা আজকের যুব সমাজের অনেকের কাছেই বিস্মৃত। আজকের বলবো এই তিন বীর শহীদের বীর সংগ্রামের কাহিনী।

১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, অধুনা বাংলা দেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামে জন্মেছিলেন বিনয় কৃষ্ণ বসু । তার বাবা রেবতীমোহন বসু ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু বিনয় হতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক। তাই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করার পর তিনি ভর্তি হন মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে, যেটি বর্তমানের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ নামে পরিচিত। এ সময়ই তিনি সংস্পর্শে আসেন ঢাকা-কেন্দ্রিক বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের এবং যুক্ত হন যুগান্তর পার্টির সাথে। পরে তিনি যোগ দেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর গড়ে তোলা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে। এভাবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে ডুবে যাওয়ার ফলে চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ন শেষ করতে পারেননি তিনি।

অন্যদিকে দীনেশ গুপ্তের জন্ম ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর,অধুনা বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার যশোলঙ গ্রামে। তার বাবা সতীশচন্দ্র গুপ্ত এবং মা বিনোদিনী দেবী। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নির্ভীক, বেপরোয়া ও বাগ্মী। ঢাকা কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনিও যোগ দেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে।

বাদল গুপ্তের জন্ম নাম সুধীর গুপ্ত। তিনি ১৯১২ সালে ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চলের পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় যখন তিনি বিক্রমপুরের বানারিপাড়া স্কুলে পড়াশোনা করছিলেন, তখন থেকেই শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের মাধ্যমে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন । পরে তিনিও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স গঠন করেছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯২৮ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে আগত মতিলাল নেহরুকে সামরিক কায়দায় অভিনন্দন জানাবার নাম করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অনুপ্রেরণায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স গঠন করেন নেতজী। আদপে এই সংগঠনটি গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করা। তাই কংগ্রেস সভা শেষ হওয়ার পর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সকে আরো সংগঠিত করে তোলার কাজ শুরু হয়। সংগঠনের জিওসি নেজাতী থাকলেও দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল মেজর সত্য গুপ্তের কাঁধে। সত্য গুপ্ত সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে তেজোদ্দীপ্ত ও উদ্যমী, দেশপ্রেমী তরুণদের একাট্টা করতে থাকেন। এবং সেই সূত্র ধরেই এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হন বিনয়, বাদল, দীনেশরা।

এদিকে দিনে দিনে ইংরেজদের অন্যায়-অত্যাচার বেড়েই চলতে থাকে। ব্রিটিশ পুলিশরা শয়ে শয়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে জেলে আটকে রেখে, তাদের উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে। সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বক্সীর মতো নেতাদেরও গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটকে রাখা হয়। এভাবে ক্রমশই সেখানকার নির্দিষ্ট ওয়ার্ডগুলো রাজনৈতিক বন্দিদের ভিড়ে উপচে পড়ছিল। ফলে সৃষ্টি হয় এক চরম অসহনীয় অবস্থা। বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে রাজবন্দিদের মাঝে। তাই তারা জেলকোড মেনেই কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। রাজবন্দিদের এই আন্দোলনকে ভালো চোখে দেখেনি ব্রিটিশ পুলিশ। তারা আন্দোলন দমানোর লক্ষ্যে বেদম লাঠিচার্জ করে। এর থেকে রেহাই পাননি সুভাষ চন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন এবং সত্য বক্সীরা মতো নেতারাও। এমন খবর চাপা থাকেনি। ক্রমে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল রাজবন্দিদের উপর অত্যাচারের খবর। জানা গেল, এই অত্যাচারের নেপথ্যে রয়েছেন খলনায়ক ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন এস সিম্পসন।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের নেতারা কর্নেল সিম্পসনকে হত্যার পরিকল্পনা করলেন। তার জন্যে বেছে নেওয়া হল বিনয় কৃষ্ণ বসুকে। তাঁর নেতৃত্বে মহাকরণ অভিযানের ছক কষা হয়। কর্নেল সিম্পসনের অফিস ছিল রাইটার্স বিল্ডিং বা মহাকরণে। বিনয়ের সঙ্গে বাছা হয় আরও দুই সাহসী বিপ্লবী বাদল ও দীনেশকে। কারণ একই অঞ্চলে জন্মলাভের সূত্র ধরে কিশোর বয়স থেকেই পরস্পরকে চিনতেন বিনয়, বাদল ও দীনেশ। তাই অন্য কারো চেয়ে এই ত্রয়ীই ঠিকঠাক কাজটি করতে পারবে বলে বিশ্বাস ছিল নেতাদের।

এই অভিযান যে আত্মঘাতী হতে চলেছে তা জানত তিন সাহসী যুবক বিপ্লবীই। কারণ ব্যস্ত সময়ে পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীদের নজর এড়িয়ে পালানো ছিল অসম্ভব। তাও শেষ লড়াই চালিয়ে যান তিন বিপ্লবীই। কর্নেল সিম্পসনকে হত্যার পর মহাকরণ ভবনের অলিন্দে নিরাপত্তারক্ষী ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বন্দুকের বুলেট শেষ হয়ে যাওয়ায় একটি শূন্য কামরায় প্রবেশ করেন বিপ্লবী ত্রয়ী। পুলিশের হাতে ধরা দিতে না চাওয়া তিন ত্রয়ীর মধ্যে বাদল পকেট থেকে পটাশিয়াম সায়ানাইড বের করে সেটি গলধঃকরণ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। অন্যদিকে বিনয় ও দীনেশ নিজেদের রিভলবারের শেষ দুটি বুলেট চালিয়ে দেন নিজেদের মাথা লক্ষ্য করে। গুরুতর আহত দুজনকে ইংরেজ পুলিশবাহিনী বন্দি করে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেয়। দুই বিপ্লবীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে থাকে ব্রিটিশ প্রশাসন। কিন্তু বিনয় যে ছিলেন মেডিকেলের ছাত্র। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর তাঁর ভালোই দখল ছিল। তিনি সবার অলক্ষ্যে ক্ষত জায়গা আঙুল দিয়ে ঘেটে দেন। ফলে সেপটিক হয়ে যায় ক্ষতস্থানে এবং ১৯৩০ সালের ১৩ ডিসেম্বর দেশ মাতৃকার জন্য শহীদ হন তিনি। অন্যদিকে দীনেশ ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠেন। তাঁকে পাঠানো হয় জেলে। শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া এবং তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তবে মৃত্যুর আগে তিনি জেলে বন্দি সুভাষ চন্দ্র বসুর চরণ স্পর্শের সুযোগ পান।

যতদিন বাঙালি বেঁচে থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবে নির্ভীক বাঙালি এই ত্রয়ী বিপ্লবীর রোমহর্ষক অলিন্দ যুদ্ধের কাহিনী। যা উদ্বুদ করে চলবে যুব সমাজকে। শেখাবে দেশকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার পাঠ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments