বিশেষ প্রতিবেদনঃ তারা কোনও অন্যায় আবদার করে নি, তারা চেয়েছিল তাদের প্রাপ্য পাওনা, হ্যাঁ ঠিক, এইমুহূর্তে তিলোত্তমার বুকে যে অভুক্ত মুখ গুলো তাদের প্রাপ্যের জন্য টানা ২৭ দিন ধরে আমরণ অনশন চালিয়ে যাচ্ছে সেইসমস্ত উচ্চশিক্ষিত পড়ুয়াদের কথাই বলছে এই বাংলায়। স্কুল সার্ভিস উত্তীর্ণ পড়ুয়াদের এহেন আমরণ অনশন পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এক কালো ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছে। কারণ, আজ থেকে ঠিক ১২ বছর আগে সিঙ্গুর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঠিক এভাবেই অনশনে বসেছিলেন। টানা ২৫ দিন পর সেই অনশন ভঙ্গ হয়েছিল। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে সেদিনের সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে, তার কাছে এই আমরণ অনশনের দুর্বিসহতা অজানা নয়, কারণ ১২ বছর আগে সেদিনের সেই সিঙ্গুর আন্দোলনে তিনিও মানুষের দাবীদাওয়া নিয়েই অনশনে বসেছিলেন। সেই একইভাবে আজ শহরের রাস্তায় অভুক্ত অবস্থায় ২৭ দিন ধরে পড়ে রয়েছে বর্তমান প্রজন্ম। কিন্তু কেন? কেন এভাবে ভুলুন্ঠিত হবে যুব সমাজ। ছোটবেলা থেকে এইসমস্ত পড়ুয়াদের কানে তাদের অভিভাবকেরা গুঁজে দিয়েছিলেন সরকারী চাকরি পেতেই হবে, সরকারী চাকরি ছাড়া ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তারা শুনেছিল অভিভাবকদের কথা, কঠোর অধ্যাবসায়ের সঙ্গে একে একে উত্তীর্ণ হয়েছে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিএ, এমএ, বিএড, বিপিএড এবং সর্বোপরি স্কুল সার্ভিস পরীক্ষাও। আর তাদের সেই সরকারী চাকরি পাওয়ার স্বপ্নের পেছনে চোখ বন্ধ করে আর্থিক সহযোগিতা করে গেছেন তাদের অভিভাবকেরা। এই ভেবে, যাক এবার তাহলে ছেলে বা মেয়ের চাকরিটা হয়ে যাবে। শেষ জীবনটা ছেলে মেয়ের নিশ্চিন্ত ছত্রছায়ায় পেরিয়ে যাবে। কিন্তু হায় রে তাদের পোড়া কপাল! তাদের সেই সমস্ত স্বপ্ন এক ঝাপটায় চুরমার হয়ে গেছে সরকারী উদাসীনতা আর সদিচ্ছার অভাবে। আর সেইসমস্ত ভবিষ্যৎ শিক্ষক যারা চপশিল্প বা বিড়ি শিল্পকে আকড়ে ধরতে পারে নি তাদের ঠিকানা আজ কলকাতার ধুলোময় রাস্তা, অভুক্ত অবস্থায় রাস্তার ধারে মশারীর তলায় তাদের কাছে “বসন্তের পূর্নিমার চাঁদ আজ সত্যিই ঝলসানো রুটি”। কি এমন চেয়েছিল তারা? তারা শুধু চেয়েছিল এসএসসি নিয়োগের ধারাবাহিকতা আর স্বচ্ছতা। কারণ আজ সরকারী চাকরি পেতে গেলে মেধাবী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, পড়ে শুধু অদৃশ্য হাতের ছত্রছায়া, আর পকেটে মোটা নোটের বান্ডিল। এই দুই যদি কারোর কাছে থাকে তাহলে পরীক্ষার হলে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে সাদা খাতা জমা দিলেও মেধাতালিকায় চাকরিপ্রার্থীর নাম থাকবে সেটা হলফ করে বলে দেওয়া যায়। আর বাকি মেধাবী পড়ুয়াদের ছুটতে হয় চপ ভাঁজতে আর বিড়ি বাঁধতে আর তাও যদি না জোটে তাহলে মহানগরীর রাস্তায় পাতলা ফিনফিনে চাদর পেতে আর পুলিশের রুলে গুঁতো খেয়ে অভুক্ত রাত কাটাতে হয় শুধুমাত্র সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করতে। আহা! কি পরিবর্তন! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলবো না। কী করে ভুলবে আজ ২৭ দিন ধরে রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা ওই সমস্ত ভবিষ্যত প্রজন্ম? পাড়ার রকে আড্ডা না মেরে, লম্পট যুবকদের মতো নেশাগ্রস্ত না হয়ে কিংবা ক্রিকেট ব্যাটের বদলে পড়ার বই আর পেন তুলে নেওয়ার শাস্তিই কি এদের পেতে হচ্ছে? বিশ্বাস করাই কঠিন যে গত ৭ বছর ধরে রাজ্যে এসএসসি নিয়োগই বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার? কিন্তু এবিষয়ে কোনও খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। এমনকি ৪০০ জন পড়ুয়া ২৭ দিন ধরে কলকাতার রাস্তায় পড়ে থাকার পরেও সমস্ত সংবাদমাধ্যম কি অদ্ভূত নিশ্চুপ? কিন্তু কেন? অথচ শহরেরই কোনও সেলেব্রিটি যখন রাজনীতির আঙিনায় পা রাখছেন তখন সেইসমস্ত সংবাদমাধ্যমের ফিরিস্তি শুনলে কোনও সুস্থ মস্তিস্কের মানুষের পক্ষে তা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এত কিছুর পরেও আদৌ কী কোনও সুরাহা হবে? আদৌ কী ওই ৪০০ পড়ুয়ার আমরণ অনশন টলাতে পারবে রাজ্য সরকারের ইস্পাত কঠিন মনুষ্যত্বকে? নাকি এভাবেই অভুক্ত অবস্থায় তিলোত্তমার রাস্তায় পড়ে থেকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে ওই ৪০০ জন পড়ুয়াকে? এই রাজ্যের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদেরও অপেক্ষা ছাড়া কোনও গতি নেই।