নিউজ ডেস্ক, এই বাংলায়ঃ রাজ্য জুড়ে অবৈধ বালি পাচার নতুন কোনও ঘটনা নয়। প্রকৃতির নিয়মে যেমন দিন আসে দিন যায় তেমনি রাজনীতির নিয়মে ভোট আসে, ভোট যায়, কিন্তু অবৈধ বালি পাচার থেকে যায়। ভোটের ফল প্রকাশের পর সরকার পরিবর্তন হলেও অবৈধ বালি পাচারের রমরমা কারবার বন্ধ হয়না। আর বন্ধ হবেই বা কেন? কালো হিরে হিসেবে পরিচিত কয়লার মতোই বালি পাচারের ব্যবসায় বিশাল অঙ্কের মুনাফা মাফিয়াদের বালি কারবারের দিকে আকৃষ্ট করে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন কাঁকসার অজয় নদী, পশ্চিম বর্ধমান, পূর্ব বর্ধমান, অন্ডাল, বাঁকুড়া জেলার দামোদর নদী সহ বিভিন্ন ঘাটে বছরের পর বছর ধরে অবৈধ বালি উত্তোলন খুল্লাম খুল্লা চললেও প্রশাসনের বারংবার চেষ্টার পরেও বন্ধ হয়নি বালি পাচারের কারবার। চলতি বছরে সদ্য সরকারি তরফে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে সমস্ত জায়গায় নদী থেকে কোনোভাবেই বালি তোলা যাবে না। কিন্তু আদতে কি সেই সরকারি নির্দেশিকা মান্য করা হচ্ছে? উত্তরটা যে “না” তা খোদ সরকারও জানে। সরকারি নির্দেশিকা জারির পরেও বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিম বর্ধমান, পূর্ব বর্ধমানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নদী ঘাটগুলিতে ঘুরে দেখা গেল অবৈধ বালি উত্তোলন যেমন চলছিল তেমনি আছে বহাল তবিয়েতে শুধু বদলেছে বালি তোলার ধরণ। বছরের বেশির ভাগ সময় বালি মাফিয়ারা নদী থেকে বালি উত্তোলনের জন্য ব্যবহার করে জেসিবি, পোকলেনের মতো ভারী যন্ত্রপাতি। কিন্তু রাজ্যে বর্ষা ঢুকতেই এবং বালি উত্তোলনে রাজ্যে সরকারী নিষেধাজ্ঞা জারি হতেই নতুন পন্থা নিয়েছে বালি মাফিয়ারা। সকাল থেকেই বিভিন্ন নদীতে চোখে পড়বে নৌকা। প্রাথমিকভাবে দেখলে মনে হবে, নদীতে নৌকা আর নতুন কী, মাছ ধরার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারাই নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরছে। কিন্তু না, একটু ভালো ভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে নৌকায় থাকা তিন চারজন স্থানীয় বাসিন্দা বালতিতে করে নদী থেকে বালি তুলে তা বস্তায় ভরে নৌকায় জমা করছে। সেই বালিই ট্রাক্টরে ভর্তি করে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। এরকমই কিছু স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা জানান, এমনিতেই বড় বড় যন্ত্রপাতির জন্য তাদের কাজ চলে গেছে, তাই এই কটা দিন নদী থেকে বালতি করে বালি তুলে ট্রাক্টরে ভর্তি করে দিয়ে তাদের জীবিকা চলে। একদিকে যেমন তাদেরও কিছু রোজগার হয় তেমনি বালি মাফিয়াদের বালি পাচারের কাজও স্বাভাবিক থাকে। বালি ব্যবসায়ীদের বয়ান থেকে জানা যায়, এক ট্রাক্টর বৈধ বালির দাম ১৭৫০ টাকা, সেখানে চালান ছাড়া অবৈধ বালির দাম ট্রাক্টর প্রতি ১১৫০ টাকা। তাই দামের এই বড় ব্যবধানের জন্য চালানহীন বালির চাহিদাও বেশি থাকে সারা বছর। তাদের অভিযোগ, বালি মাফিয়াদের সঙ্গে শাসকদলের বহু হেভিওয়েট নেতা-নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সরকারি ও প্রশাসনিক দফতরের আধিকারিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আর্থিক লেনদেন থাকায় দিনের পর দিন বেআইনিভাবে বালি পাচার চললেও বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কোনও আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি পুলিশের দিকে আঙুল তুলেও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রত্যেক মাসে বিভিন্ন বালি ঘাট থেকে স্থানীয় থানা থেকে শুরু করে উঁচুস্তরের পুলিশ আধিকারিকদের কাছে মাসিক মোটা টাকা পৌঁছায় বালি মাফিয়াদের কাছ থেকে। ফলস্বরূপ বিভিন্ন বালি ঘাটে প্রশাসনিক অভিযান শুরুর আগেই খবর পৌঁছে যায় বালি মাফিয়াদের কাছে। স্বাভাবিকভাবেই রাতারাতি বালি ঘাট ফাঁকা করে সরে পড়ে বালি মাফিয়ারা। ব্যর্থ হয় প্রশাসনিক অভিযান। এহেন নানান দৌরাত্ম্যের মধ্যেই বালি ব্যবসায়ীদের আরও অভিযোগ, রাজ্যে লোকসভা ভোটে বিজেপির শক্তি বৃদ্ধির ফলে পরিবর্তন ঘটেছে অবৈধ বালি খাদানেও। ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, বিভিন্ন বালি ঘাটের মাফিয়াদের সঙ্গে বর্তমানে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তৈরী হয়েছে বেশ কিছু ছোট-বড় বিজেপি নেতৃত্বের। মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বালি মাফিয়াদের যে স্বর্গরাজ্য রয়েছে সেখানে বালি মাফিয়াদের সঙ্গে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাহলে কী রাজ্যে বিজেপি শক্তিবৃদ্ধির ফলে বালি মাফিয়ারাও তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির দিকে ক্রমশ ঝুঁকছে? অবাস্তব কিছু নয়, কারণ লোকসভা ভোটে যেভাবে শাসকদলকে নাকানি-চোবানি খাইয়েছে গেরুয়া শিবির তাতে আগামী দিনে রাজ্যে গেরুয়া সরকার আসবে না তা হলফ করে বলার সাহস কোনও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞেরও নেই। তাই এরকম পরিস্থিতিতে নিজেদের সাম্রাজ্য বাঁচাতে বালি মাফিয়াদের “গেরুয়া প্রীতি” কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এরই মধ্যে নতুন করে অভিযোগ উঠেছে, অবৈধভাবে বালি মজুত করে রাখাকে কেন্দ্র করে। ঘটনাস্থল পূর্ব বর্ধমানের খন্ডঘোষ এলাকার দামোদর পার্শবর্তী এলাকার। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন All India Anti Corruption Organisation। যাদের মূল কাজ, সমাজে চলা বিভিন্ন স্তরের দূর্নীতির পর্দাফাঁস করা। বালি মাফিয়াদের নিয়ে তাদের একটি অভিযোগ পত্র সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক, ভূমি ও রাজস্ব দফতর এবং খন্ডঘোষের বিএলএলআরও-র কাছে দেওয়া হয়েছে। তাদের সেই অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, অনিতা বর্মন, প্রভাত বাউরী, পাপন ঘোষ, গৌতম পাল এবং রাজা ঘোষ নামে এই পাঁচজন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে দেওয়া লিজের মাধ্যমে পূর্ব বর্ধমানের খন্ডঘোষ থানা এলাকার নারিচা মৌজা এলাকায় ৬০,০০০ কিউবিক বালি তোলার অনুমতি পায়। সেই মতো তাদের লিজ নিয়ন্ত্রিত দামোদর নদী থেকে তারা বালি উত্তোলনের কাজ শুরু করে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, নদী থেকে বালি উত্তোলন করে বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় তা বেআইনিভাবে মজুত করে রাখা হচ্ছে বলে। ২০০২ সালে নির্ধারিত বেআইনী খাদান, পরিবহণ এবং মজুত আইনের আওতায় যা সম্পূর্ণ বেআইনি। সরকারি এই আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বালি উত্তোলনের লিজ প্রাপ্ত যেকোনো সংস্থা বা ব্যক্তিকে খাদান শুরু করার পূর্বে অন্তত পক্ষে ১৫ দিন আগে স্থানীয় সরকার নিযুক্ত আধিকারিককে বালি মজুতের স্থান এবং পরিমাণ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। অভিযোগ, এক্ষেত্রে এই পাঁচজন ব্যক্তি সরকারী সেই আইন ভঙ্গ করেই দিনের পর দিন জায়গায় জায়গায় পাহাড় প্রমাণ বালি মজুত করে চলেছে। শুধু তাই নয়, যেকোনো লিজপ্রাপ্ত সংস্থাকে খাদান চালাতে গেলে বেশ কিছু সরকারী আইন মেনে চলতে হয় যার কোনওটিই তারা মানছেন না বলেও অভিযোগ পত্রে জানানো হয়েছে। যেমন-
১। বালি বা যেকোনো খনিজ সম্পদ মজুত রাখার এলাকার পরিমাপ প্রদান।
২। সম্পদ মজুত করার নির্দিস্ট এলাকার বিবরণ।
৩। সঠিক কি ধরণের খনিজ সম্পদ উত্তোলন এবং মজুত করা হচ্ছে।
৪। দৈনিক কত মেট্রিক টন বালি বা খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা হচ্ছে তা তালিকাভুক্ত করা।
৫। দৈনিক কত পরিমাণ বালি বিক্রি হচ্ছে তা নথিভুক্তকরন।
অভিযোগকারী তার অভিযোগ পত্রে সাফ জানিয়েছেন উপরিউক্ত কোনও সরকারী নির্দেশিকায় ওই পাঁচজন লিজ প্রাপক মানছেন না। ফলে একদিকে যেমন তারা সরকারী আইন অমান্য করে বালি খাদান চালিয়ে যাচ্ছেন তেমনি, সরকারী রাজস্বকেও ফাঁকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ। All India Anti Corruption Organisation নামক বেসরকারী দূর্নীতি দমন সংস্থার আধিকারিক শ্রী সুব্রত মল্লিক জানিয়েছেন, দিনের পর দিন খন্ডঘোষ থানা এলাকার দামোদর নদী এলাকায় সরকারী লিজপ্রাপ্ত ওই বালি খাদান থেকে বালি তুলে সরকারী নির্দেশ অমান্য করে তা মজুত এবং সরবরাহ করা হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে প্রশাসনকে অবহিত করতে ইতিমধ্যেই তিনি তার অভিযোগ পত্রটি পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক, ভূমি ও রাজস্ব দফতর এবং খন্ডঘোষের বিএলএলআরও-র কাছে পাঠিয়েছেন। দ্রুত এই বেআইনি কার্যকলাপ বন্ধ করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন তিনি।