জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,বাঁকুড়াঃ- বর্তমানে যেখানে দু’দশটা পরিবার একতাবদ্ধভাবে পুজো করতে পারেনা সেখানে প্রায় গত সাড়ে চারশ বছর ধরে শতাধিক পরিবার এই দুরূহ কাজটি করে চলেছে এবং একইভাবে। ঘটনাটি বাঁকুড়া জেলার গঙ্গাজলঘাটি থানার অন্তর্গতবিহারজুড়িয়া গ্রামের রায় পরিবারের। জন্মসূত্রে এদের পদবী ছিল মুখার্জ্জী। তারা ছিল বিষ্ণুপুরের রাজার গোমস্তা। তাদের কাছ থেকেই তারা ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি পান। আদি বাড়ি তালডাংরা থানার মাণ্ডি গ্রামে। সেখান থেকে চলে আসে আসনচুয়া গ্রামে এবং পরে বিহারজুড়িয়ায়। এখানেই প্রচলন করেন পারিবারিক দুর্গাপুজোর। প্রসঙ্গত সংশ্লিষ্ট গ্রামটির প্রায় সমস্ত সদস্য রায় পরিবারের।
গ্রামে আরো তিনটি পুজো হলেও রায় বাড়ির ‘বড়মেলার’ পুজোর গুরুত্ব সবদিক থেকে আলাদা। আন্তরিকতা, মাটির টান, আলোকসজ্জা- অভিনবত্বের দাবি রাখে।
প্রথম থেকেই ‘মা’ এখানে সপরিবারে এক পাটাতনেই আসেন। পরিবারের প্রবীণদের বক্তব্য – বছরে ‘মা’ একবার আসেন। সেখানে সন্তানদের কি করে আলাদা রাখা যায়? এ’হলো ভক্তির নিদর্শন। যাইহোক সপ্তমীর দিন মায়ের আগমনে নব পত্রিকা স্থাপন ও দশমীর দিন বিদায়ের সুরে পরিবারের সবার উপস্থিতিতে রায়বাঁধ পুকুর চত্বর হয়ে ওঠে ঐক্যের প্রতীক। সেখান থেকেই শোভাযাত্রা করে আনা হয় পুজোর ঘট। পা মেলায় প্রবীণ থেকে বর্তমান প্রজন্মের আধুনিক নবীন সদস্যরাও। এটা যে ওদের পূর্ব পুরুষদের পুজো। আগে অষ্টমী ও নবমীতে বলি হলেও এখন সব বন্ধ।
তবে পুজোর সেরা আকর্ষণ থাকে নবমীর দিন। অষ্টমীর সন্ধ্যা থেকেই সাজ সাজ রব। গ্রামের পুরুষ-মহিলারা একসঙ্গে বসে সবজি, মাছ কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দিনের আলো ফোটার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় রান্না। কারণ পরের দিন প্রায় সাড়ে তিন সহস্রাধিক রায় পরিবারের সদস্যদের জন্য নবমীর ভোজ হবে। সবাই পাশাপাশি বসে আহার করবে। লোকসংখ্যা বেশি হলেও কখনোই সেখানে বিশৃঙ্খলা থাকেনা। সব যেন বিনি সুতোর মালায় গাঁথা। সত্যিই এএক বিরল দৃশ্য। দশমীর দিন সকাল থেকেই রায় পরিবারে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। রীতি মেনে করা হয় ঠাকুর বরণ। নিজেদের মধ্যে মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। ওদিকে ‘মা’ ফিরে যাবে কৈলাসে, আর এদিকে অনেকেই ফিরে যাবেন নিজ নিজ বাসস্থানে। আসলে কর্মসূত্রে রাজ্য তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে এই পরিবারের সদস্যরা। পুজোর সময় সবাই এক জায়গায় মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। তাইতো সেই সুযোগ কেউই ছাড়তে চায়না। এমনকি পরিবারের বিবাহিতা কন্যারাও এই সময় বাপের বাড়ি আসে। কার্যত মহালয়ার পরদিন থেকে দশমী পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির জন্য সুখময় পরিবেশের সৃষ্টি হয় বড়মেলার পুজোয়।
রায় বাড়ির মেয়ে তথা বর্ধমানের গৃহবধূ অতসী বর্ণা দেবী বলেই ফেললেন – যতই শহরের গৃহবধূ হইনা কেন পুজোর সময় মন টানে আমার গ্রাম। কারণ বছরে একবারই সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। পরে হাসতে হাসতে বললেন- ‘মা’ তার স্বামী মহাদেবকে সঙ্গে না আনলেও আমি কিন্তু স্বামী রাণা চ্যাটার্জ্জীর হাত ধরে চলে আসি এখানে।
পুজোর সময় মোটামুটি চারদিনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে পরিবারের সদস্যরাই অংশগ্রহণ করে। পরিবারের অন্যতম সদস্য সত্যজিত রায় বললেন – রায় বাড়ির পুজো মানেই মিলনমেলা। মহালয়ার পর থেকেই অন্যত্র বসবাসকারী পরিবারের সদস্যদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এই মেলার। হাসিঠাট্টায় কেটে যায় চারটে দিন। মনে হয় আর একটু হলে ভাল হয়। দশমীতে হৃদয়ে বেজে ওঠে বিদায়ের সুর। সঙ্গে নীরব প্রতিজ্ঞা – আসছে বছর আবার হবে।