জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,মঙ্গলকোটেঃ– দেখতে দেখতে একশ বছর পার হয়ে গেল। রাত শেষ হওয়ার মুখে। ভোরের পাখিরা কিচিরমিচির ডাক দিয়ে আসন্ন সকালের ইঙ্গিত দিচ্ছে। মঙ্গলকোটের গণপুরের রেণুপদ মাজি জালপাড়ার শ্মশান মোড় সংলগ্ন জমির ফসল পাহারা দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা কোনোরকম টানতে টানতে বাড়ি ফিরছে। এটা ছিল তার দৈনন্দিন ডিউটি। হঠাৎ দেখে তার পিছনে পিছনে বছর বারো তেরোর এক কিশোরী মেয়ে আসছে। কার মেয়ে, কোথা থেকে আসছে, এই সময় কোথায় যাবে- মনের মধ্যে উঁকি দেওয়া এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার মত ইচ্ছে বা আগ্রহ রাত জাগা ক্লান্ত রেণুপদর ছিল না। তার একমাত্র ইচ্ছে কোনোরকমে বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেওয়া। বাড়ির কাছাকাছি পুকুরে হাত-পা ধুয়ে যখন বাড়ির দিকে সে পা বাড়িয়েছে তখন দেখা যায় সেই কিশোরীটি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু না ভেবেই বাড়িতে ঢুকে ক্লান্ত রেণুপদ বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। অচিরেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। তারপর ঘটে যায় সেই অলৌকিক ঘটনা।
ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখে – সেই কিশোরী তাকে বলছে আমাকে নিয়ে যাবিনা। আমি কতক্ষণ পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকব। ধরফর করে রেণুপদ উঠে পড়ে। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। পাশে শুয়ে থাকা তার স্ত্রী স্বামীর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়। সমস্ত ঘটনা স্ত্রীকে খুলে বলেন রেণুপদ। ইতিমধ্যে পাড়ার অনেকেই হাজির। স্বামীকে অনুসরণ করে সে দেখতে পায় পুকুর পাড়ে রয়েছে এক কালীমূর্তি। কোথা থেকে এই মূর্তি এলো সেটা ভাবার সময় তাদের ছিলনা। রেণুপদ দেখে মূর্তির মুখটা পিছনে পিছনে আসা অবিকল সেই কিশোরীর মুখের মত।
সবাইকে অবাক করে মূর্তির দু’পা জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে থাকে। তার একটাই আপসোস মা’কে সে চিনতে পারেনি। পাড়ার প্রবীণরা মূর্তি বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। গরীব মানুষ সে। কোথায় রাখবে মা’কে। কিভাবেই বা পুজোর খরচ জুটবে – এইসব ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। সবার আশ্বাসে মাথায় করে বাড়িতে আনে মায়ের মূর্তি। ইতিমধ্যে কেউ বা কারা তালপাতা দিয়ে বাড়িতে তৈরি করে ফেলেছে মায়ের থাকার জায়গা। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করা হয় মায়ের মূর্তি। শ্মশান থেকে আসার সময় মূর্তিটি পাওয়া যায় বলে নাম হয় শ্মশান কালী, কেউ বলে কালো কালী।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটানা কাহিনী বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠে মাজি পরিবারের অন্যতম সদস্য অক্রূর মাজি। চোখেমুখে ছিল একরাশ শ্রদ্ধা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার সে বলতে শুরু করে –
তারপর থেকেই শুরু হয় পুজো এবং সেটা রেণুপদর পুত্র সিদ্ধেশ্বর ও পরে তার পুত্রদের হাত ধরে এখনো একইভাবে চলে আসছে পুজো। যেহেতু শ্মশান থেকে আসার সময় এই কালীর আবির্ভাব ঘটে তাই প্রথমে মাজি পরিবারের কোনো সদস্য জালপাড়া শ্মশান মোড়ের কালীর পুজো করা পরই বাড়িতে মূল পুজো শুরু হয়। এই প্রথা আজও চলে আসছে।
অক্রূরের কাছে জানা গেল – সন্তান কামনায় আশেপাশের গ্রামের অনেকেই ঠাকুরের মানসিক করেন, ছাগ বলি দেয়। অনেকের নাকি মনস্কামনা পূরণও হয়েছে। কেউ কেউ মায়ের আশীর্বাদে পাওয়া সন্তানের নামও রেখেছে ‘কালী’।
আরও জানা গেল- পুজোর শেষে যে পুকুরে মূর্তি বিসর্জন করা হয় যদি মায়ের কাঠামোয় পা ঠেকে যায় সেই আশঙ্কায় অনেকেই পুকুরে নামতে ভয় পায়। নামলেও সতর্ক থাকে।
বংশ পরম্পরায় ঠাকুরের মূর্তি তৈরি করে চলেছে গণপুরের সূত্রধর পরিবার। শোনা যায় মূর্তি তৈরি করার সময় দৈর্ঘ্যে ঠাকুরের আকৃতি ছোট করার জন্য নাকি ধর্মা সূত্রধরের মুখ বেঁকে যায়। এখন মূর্তি তৈরি করে বাবলু সূত্রধর।
অক্রুর বললেন – পুজোর সেবাইত আমরা হলেও মা কিন্তু সবার। তাইতো পাড়ার সমস্ত মানুষ পুজোয় অংশগ্রহণ করে, আনন্দ করে। মায়ের আশীর্বাদে সব কিছুই জুটে যায়। তার কাছে আরও জানা গেল – বছর কুড়ি আগে তালপাতার পরিবর্তে স্থায়ী মন্দির নির্মিত হয়েছে। সবই মায়ের আশীর্বাদ – এটা শুধু পাড়ার প্রবীণরা নয় নবীন প্রজন্মও বিশ্বাস করে। তাইতো সুযোগ পেলেই সবাই মায়ের আশীর্বাদ নিতে মন্দিরে ছুটে যায়।