মনোজ কুমার সিংহ, দুর্গাপুরঃ- শহরে নতুন রোগ পিঙ্ক ট্র্যাপের ফাঁসে নাকাল হচ্ছেন পকেট গরম থাকা দুর্গাপুরের কিছু ফূরতিবাজ মাঝ বয়সী মানুষ আর তাদের অবস্থাটা দাঁড়াচ্ছে এমনই যে – একবার ফেঁসে গিয়ে লোকলজ্জার ভয়ে সেখান থেকে বেরোতে না পেরে মোবাইল ফোনে নখরা করা মেয়েদের ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নীরবে সর্বস্ব খুইয়ে তারা পালাবার পথ খুঁজে মরছেন।
পৃথিবীর সৃষ্টির পর থেকে মানুষের মধ্যে দুটি ব্যবসা সব থেকে পুরাতন একটি সুদের কারবার ও অন্যটি নারী দেহের ব্যবসা। পশ্চিম বর্ধমান জেলার শিল্পাঞ্চলে এই দুটি ব্যবসায় এখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে ও নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাইটেক্ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্পাঞ্চল দূর্গাপুর ও আসানসোল এলাকার বহু অভিজাত এলাকায় বাসা বেঁধে বসেছে একদল হাইটেক দেহ ব্যবসার কারবারীর। তাদের কব্জায় রয়েছে ঝকঝকে কচি পাল পাল মেয়ে- যারা মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলে দারুণ সড়গড় তো বটেই, তারা দরকার মতো অনলাইনে জামাকাপড় খুলে ন্যাকেড হতেও ইতস্ততঃ করে না। সাথে থাকে অনর্গল অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ চটুল কথার ফুলঝুরি।
দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের সিটি সেন্টার, বেনাচিতি, ইস্পাত নগরী ও বিধাননগরের বিভিন্ন বিউটি পার্লারের আড়ালে এতদিন রমরমিয়ে চলতো দেহ ব্যবসা। আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে যদিও তা করা প্রায় কঠিনই ছিল। সময় মতন মধুচক্রের ডেরাই হানা দিয়ে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগ একাধিকবার, একাধিক মহিলা ও পুরুষকে রঙ্গেহাত ধরে গ্রেফতারও করেছেন । তারপর থেকেই পুলিশের এই কড়া চক্ষুকে আড়াল করে শিল্পাঞ্চলের কিছু দুষ্ট চক্র এখন শিল্পাঞ্চলের বিধাননগর, সিটি সেন্টার ও বেনাচিটি সহ ইস্পাত নগরীর বেশ কিছু জায়গায় অবৈধ পেশার ধরন বদলে এই হাইটেক দেহ ব্যবসার আয়োজন করে বসেছে । কয়েকদিন আগে বিধাননগরের ডি- ১২১ সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত সরণীর একটি বাড়িতে দেহ ব্যবসা চলার অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় কয়েকজন ক্যামেরা পার্সন গোপন ক্যামেরায় তাদের কথোপকথন রেকর্ড করেন। চাঞ্চল্যকর ওই ভিডিও কথাপকথনে এক মহিলা নিজেকে ‘রুমা’ নামে পরিচয় দিয়ে গড়গড় করে বলেই দিলেন, “দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বিধাননগরে ব্যবসা চালাতে আমাদের কোনো রকম অসুবিধাই হচ্ছে না। নেই কোন পুলিশি ঝামেলা, কারণ প্রত্যেক মাসে মোটা টাকা প্রণামী নেয় স্থানীয় ফাঁড়ির পুলিশ।” শুধু তাই নয়, ওই মহিলা এও দাবি করেন, স্থানীয় বেশ কিছু রজনৈতিক নেতাও তাদের কাছে দৈনন্দিন আসেন এবং তাদের কাছ থেকে মোটা টাকা মাসোহারা, পছন্দমতো মেয়ে নিয়ে থাকেন। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের মহিলারা তো বটেই তাদের মূল দেহ ব্যবসার কাজের মহিলারা আসে সব কলকাতা, চন্দননগরের দিক থেকে। ওই কথোপকথনের ভিডিও ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তবে, পুলিশ কিন্তু রয়েছে আশ্চর্য রকমের নিষ্ক্রিয়। ঐ বাড়িটি যদিও এখন তালা বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় এলাকার মানুষজন জানিয়েছেন, ঘটনার পর দিন থেকেই এলাকা ছাড়া ওই বাড়ির আবাসিকেরা। যদি ধরে নেওয়া হয় – ঐ ভিডিওতে কথোপকথনে মহিলা যে অভিযোগ করেছেন তা সত্যি, তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় যে কাদের সাহায্যে ও মদতে চলছে শিল্পাঞ্চলের বুকে রমরোমিয়ে দেহ ব্যবসার এইসব আখড়া গুলি!
এদিকে, রাজনৈতিক নেতাদের উপর দেহ ব্যবসা চালানোর অভিযোগ করতেই নড়ে চড়ে বসেছেন দুর্গাপুরের সুশীল সমাজের বেশ কয়েকজন সুশীল নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। শাসকদলের একজন সম্মানীয় নেত্রী সামাজিক মাধ্যমে ওই ভিডিও পোস্ট করে নিজেদের অক্ষমতা জাহির করেছেন। তার কথা অনুযায়ী মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশেই নাকি তারা নিষ্ক্রিয় বলে তিনি জানিয়েছেন। প্রশ্ন- মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কি খুল্লামখুল্লা দেহ ব্যবসার ছাড়পত্র দিয়েছে? নাকি, শিল্পাঞ্চলের ভেতরে এভাবে ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়া করে এসব কারবার করার অনুমতি দিয়েছে ? নাকি, রাজনৈতিক নেতাদের যেকোনো জিনিসকে সুকৌশলে আড়াল করার অসীম শক্তির আরেকটা নিদর্শন ঐ নেত্রীর এই সাফাই? সম্ভবতঃ তার শাসিত পৌর এলাকায় চলা হাইটেক দেহ ব্যবসার কলঙক চাপা দিতে তার ‘আদুরে’ প্রশ্রয়!
দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র সিটি সেন্টারের নন কোম্পানি হাউসিং এলাকার সুকান্ত পথের দুটি একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে শিল্পাঞ্চলের কয়েকজন যুবক একটি ‘ফ্রেন্ডশিপ ক্লাব’ চালাচ্ছেন কয়েক মাস ধরে, বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফ্রেন্ডশিপ ক্লাবের আড়ালে তারা যে হাইটেক দেহব্যবসার চালাচ্ছেন তা বলাই বাহুল্য। সিটি সেন্টারের নন কোম্পানি হাউসিং এলাকার সুকান্ত পথের একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে প্রায় আট-দশটি যুবতী মহিলাকে নিয়োগ করে সকাল থেকে রাত অবধি টেলিফোন মারফত একের পর এক ব্যক্তিকে অভিজাত মহিলাদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করিয়ে দেওয়ার নামে হাজার হাজার টাকা অনলাইন মাধ্যমে আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ। এই ফাঁদে পা দিয়ে শিল্পাঞ্চলের নাম প্রকাশে অনচ্ছুক এক মাঝবয়েসি ব্যক্তি জানান, “আমার কাছে একবার ফোন এসেছিল অভিজাত এলাকার মেয়ে ও মহিলাদের সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়ার জন্য। তিনি তাতে রাজি হতেই তাকে ১৮০০ টাকা অনলাইনে একটি ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার করতে বলা হয়। তিনি তা করার সাথে সাথেই তাকে একটি মোবাইল নম্বর থেকে কোকিলা কন্ঠি এক মহিলা বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলেন। বেশ কয়েকদিন এভাবে ফোনে কথোপকথন চলার পর ওই ভদ্রলোক যখন ওই মহিলার সাথে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছুক হন তখন ওই মহিলা জানান তাকে আরো ৫৪০০ টাকা একাউন্ট মারফত অনলাইন ট্রান্সফার করতে হবে। তারপর তিনি সেই টাকা ট্রান্সফার করলে পরের দিন তাকে আবার একটি ফোন করে বলা হয় দুর্গাপুর ‘জংশন মালের’ সামনে তার সঙ্গে দেখা হবে ওই মহিলার। মাঝবয়সী ওই ভদ্রলোক সাজুগুজু করে ওই মহিলার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে গিয়ে দেখেন তিনি যার সাথে এতদিন টেলিফোনে কথোপকথন করেছেন এই মহিলার কন্ঠের সাথে তার কোন মিল নেই । আদতে এই মহিলা একজন দেহ কারবারি। তখনই তিনি ওই মহিলাকে চেপে ধরতেই বেরিয়ে আসে ‘সর্ষের ভেতর থেকে ভূত’। ওই দেহ কারবারি মহিলা জানান, দুর্গাপুরের সিটি সেন্টার এলাকার সুকান্ত পথের একটি বাড়িতে অফিস করে নিয়মিত ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে বন্ধুত্ব লোভ দিয়ে চলে এই ব্যবসা। এই ব্যবসা চালানোর জন্য ওই অফিসে প্রতিদিন ৭-৮টি করে মহিলা কাজ করে। একেকজনকে সারা দিনে ৫০ টি করে টেলিফোন করতে হয়। টেলিফোন করার জন্য পুরানো কিপ্যাড মোবাইল অর্থাৎ কম দামি মোবাইল ও একাধিক বেনামী সিম্ তাদের কাছে দেওয়া থাকে। ৫০ জনকে ফোন করলে অন্তত ১৫ জন তাদের জালে ধরা পড়ে। একেকজনের ১৮০০ টাকা করে জমা করানোর পরই তাদের প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ হয়। শুরু হয় বন্ধুত্বের কথোপকথন টেলিফোন মারফত। পাতা হয় পিঙ্ক ট্র্যপের পয়লা ফাঁদ। যদি কোন ব্যক্তি অতি উৎসাহ দেখিয়ে আবার ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করতে চান তখন তার কাছ থেকে ৫৪০০ টাকা আবার অনলাইন ট্রান্সফার নিয়ে তাকে এক দেহ ব্যবসায়ী মহিলার নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ মানুষই যখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন তখন লোক লজ্জার খাতিরে চুপচাপ হয়ে যান। সহজেই হাসিল হয়ে যায় প্রতারকদের প্রতারণা চক্রের কাজ।
কিন্তু, এবার আর তা হলো না । ওই মহিলার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ওই ব্যক্তি সুকান্ত পথের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখেন মহিলার কথার সঙ্গে এখানকার পরিবেশ হুবহু মিল রয়েছে। একটু চেঁচামেচি করতেই জানা গেল – সুকান্ত পথেরই আরেকটি বাড়িতে তাদের আরেকটি অফিস রয়েছে। শিল্পাঞ্চলের চার যুবক কলকাতার একটি ফ্রেন্ডশিপ ক্লাবের নামে চলা কোম্পানি থেকে ফ্রাঞ্চাইসি নিয়ে দুর্গাপুরে এহেন ব্যবসা শুরু করেছেন। এইসবই চলছে প্রকাশ্য দিনের আলোয়। অথচ আশেপাশে থাকা বাড়িগুলির আবাসিকরা কোন খবর কেউই প্রায় জানেন না। যে নেত্রী এই (দেহ ব্যবসা) বিষয়ে তার সুচিন্তিত মতামত পোষন করেছিলেন, তার নিজের ওয়ার্ডেই এ ধরনের অনৈতিক কাজ চললেও তার আশেপাশে থাকা কোন ব্যক্তি আজ পর্যন্ত তাকে এ বিষয়ে অবগত করেনি এ কথা বিশ্বাস করা একটু কঠিন হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল তাহলে শিল্পাঞ্চলের বুকে এ হেনো দেহ ব্যবসার আটকানোর কোন রাস্তাই কি নেই? আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশের এক পদস্থ কর্তা জানান, “কোনরকম অভিযোগ ছাড়া কি করে আমরা কারো বাড়ির ভেতরে কি অফিস চলছে জানবো বলুন তো। কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের আধিকারিকরা তৎক্ষণা তৎপরতার সাথে ঘটনার তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তা এখন সম্ভব হচ্ছে না কারণ আমাদের কাছে এখনো অব্দি কোনো রকমের অভিযোগ আসেনি। তবে আমরা আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের আধিকারিকদের এ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে বলছি ও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ শুরু করে দিচ্ছি । “
প্রশ্ন হল দুর্গাপুরের অভিজাত এলাকার সিটি সেন্টার এর একটি বাড়িতে কয়েকশো অবৈধ মোবাইলের সিম কার্ড নিয়ে চলা এই ব্যবসার এত সিম কার্ড আসছে কোথা থেকে? যেসব অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার হচ্ছে সেই অ্যাকাউন্টগুলিই বা কাদের? কারা পর্দার আড়াল থেকে সমস্ত আয়োজন করে চলেছে এই হাইটেক দেহ ব্যবসার খুঁটিনাটি? আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগের ওপর আস্থা রেখে এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা – কখন এই হাইটেক দেহ ব্যবসা পর্দা ফাঁস করেন তারা।