নিজস্ব সংবাদদাতা, দুর্গাপুরঃ- সরকারি খাস জমি হেলায় বেচে দিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন আর পাহাড় প্রমাণ ঐ টাকা সরাসরি ঢুকেছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। কখনো নগদে তো কখনো আবার চেক্ মারফত। শুধু খাস জমিই নয়, এই লুটমারের দাপটে রেহাই পায়নি বন দপ্তরের জমি, এমনকি কারো কারো ব্যক্তিগত জমিও।
শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুর এখন দ্রুত গতিতে নগরায়নের পথে। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে যেদিকেই চোখ যায় সে দিকেই দেখা যাবে সারি সারি নির্মীয়মান বহুতল আবাসন প্রকল্প। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বিধান নগর সংলগ্ন আঢ়া, কালিগঞ্জ , শংকরপুর , টেটিখেলা ও ফুলঝোড় মৌঝায় একাধিক বহুতলের নির্মাণ চলছে দ্রুত গতিতে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, একশ্রেণীর দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে ওই এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের আরো অভিযোগ, সরকারি জমি, বনদপ্তরের জমি ও পাট্টা দেওয়া খাস জমির উপর প্রায় প্রতিদিনই স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের আশ্রিত একশ্রেণীর প্রোমোটার দ্রুতগতিতে নাম পরিবর্তন ও জমির চরিত্র পরিবর্তন করে নির্মাণে সরাসরি মদত দিয়ে চলেছে আর মাথা তুলছে একের পর এক বহুতল আবাসন প্রকল্প। কিছুদিন আগে আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদে (এডিডিএ) র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় অবৈধ হাউসিং প্রজেক্ট এর নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে জানন এডিডিএ’র কোনো রকম এন ও সি বা অনুমোদন না নিয়েই অবৈধভাবেই তৈরি হচ্ছে ওইসব আবাসন প্রকল্পগুলি। ওই সাংবাদিক সম্মেলনে আড্ডার চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, অবিলম্বে এইসব আবাসন প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে এফ আই আর করা হবে । কিন্তু, কোন এক অজ্ঞাত কারণে তা এখনো হয়নি ।
এদিকে, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের আঢ়া, কালীগঞ্জ, টেটিখেলা, শংকরপুর ও ফুলঝোড় মৌজার একাধিক সরকারি জায়গা অবৈধভাবে দখল করে চলছে একের পর এক প্রোমোটারি ব্যবসা। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ – কিছু দুষ্ট প্রোমোটারি চক্রের লোকেরা রাজ্য সরকারের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগের একাধিক আধিকারিকের সঙ্গে যোগসাজসে এক জায়গায় পাওয়া অনুমতি নিয়ে অন্য জায়গায় অর্থাৎ সরকারি জায়গা বা পাট্টা দেওয়া জায়গায় বহুতল নির্মাণের ছাড়পত্র দিচ্ছেন বেপরোয়া ভাবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, জেমুয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার এক তৃণমূল কংগ্রেস নেতা – যিনি নাকি শংকরপুর নিবাসী সাধারণ একজন ইস্পাত কর্মীর সন্তান হয়েও আজ কোটিপতি শুধুমাত্র প্রোমোটারির অবৈধ টাকার লেনদেনের ফলে। ওই তৃণমূল কংগ্রেস নেতার উদ্যোগে মূলতঃ ওই এলাকায় সরকারি জমি, পাট্টা দেওয়া জমি, বনদপ্তরের জমি সহজেই দখল করে বহুতল নির্মাণ করছে এক একের পর এক প্রোমোটার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রোমোটার জানিয়েছেন, সরকারের বহু জমি বেনামে দখল করে অবৈধভাবে নাম ট্রান্সফার করে দিতে সাহায্য করেন ওই তৃণমূল কংগ্রেস নেতা। সবই মোটা টাকার বিনিময়ে। এই তৃণমূল কংগ্রেস নেতার দুটি ব্যাংক একাউন্টে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে শেষ কয়েক বছরে, বলে কয়েকটি সূত্র থেকে জানা গেছে। কোথা থেকে এলো এত টাকা তার ওই ব্যাংক একাউন্ট গুলিতে? দুর্গাপুরের শঙ্করপুরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের শাখায় তার নামের একাউন্টে কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে জানা গেছে। শুধু ওই অ্যাকাউন্টটিই নয়, বিধাননগরের গোধূলি ব্রাঞ্চেও আরেকটি রাষ্ট্রীয়ত্ব ব্যাংকের শাখায়ও কয়েক লক্ষ টাকার লেনদেন করা হয়েছে ওই তৃণমূল কংগ্রেস নেতার পক্ষে।
এক প্রোমোটার জানিয়েছেন, সরকারি জমি দখল পেতে খুবই সাহায্য করেন ওই তৃণমূল নেতা। বদলে নেন মোটা টাকার প্রণামী, তাও আবার চেক মারফত। স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ, এলাকার বহু মানুষ এখনো সরকারি জায়গায় বসবাস করছেন। কিছু পাট্টা দেওয়া জমিও আছে যেখানে গরীব মানুষরা বসবাস করছেন কয়েক দশক ধরে। দুষ্ট প্রোমোটারের চক্র সেইসব জমিও ওই গরিব মানুষগুলিকে উঠিয়ে নিজেদের প্রোমোটারি করার উদ্দেশ্যে দখল করছে – ঐ তৃণমূল কংগ্রেস নেতাকে মোটা টাকার প্রণামী দিয়ে। সব জেনেশুনেও নিরব রয়েছে দুর্গাপুর পুলিশ ও আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের আধিকারিকরা। স্থানীয় সূত্র মারফত জানা গেছে, আড্ডার একাধিক ব্যক্তির সাথে ওই তৃণমূল কংগ্রেস নেতার গোপনে আঁতাত রয়েছে, ফলে কেউ কোন অভিযোগ করলেও কাজ হয় না । রাজ্য সরকারের ভূমি ও রাজস্ব বিভাগের কয়েকজন কর্মী এই দুষ্ট চক্রকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিছুদিন আগে সাংবাদিক সম্মেলন করে আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান যে সূচি জারি করেছিলেন, তার মধ্যে একটারও নাম নেই এইসব এলাকায় গজিয়ে ওঠা অবৈধ বহুতল গুলির। সাধারণ মানুষের অভিযোগ সম্ভবতঃ মোটা টাকার লেনদেন হয়েছে, তাই, তাদের এলাকার এইসব অবৈধ প্রমোটারির ব্যবসার কোন নামগন্ধই করে না আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের কর্তা ব্যক্তিরা ।
এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা খবর পেয়ে স্থানীয় এক সমাজকর্মী দুর্গাপুর মহকুমা শাসকের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। সূত্র মারফত জানা গেছে কালিগঞ্জ এর টেটিখেলা মৌজার সরকারি জায়গায় (জেএল নম্বর-১১১ ) একটি ছয় তালা বহুতল আবাসন প্রকল্প রাতারাতি তৈরি হচ্ছে ভূতের দ্বারা। ওই আবাসন প্রকল্পর গায়ে কোথাও লেখা নেই কোন সংস্থা বা কারা এই প্রকল্পটি তৈরি করছেন। ওই বহুতল আবাসনে গিয়ে খোঁজ করে জানা গেল, স্থানীয় বিধান নগরের একটি সংস্থা নাকি ওই বহুতল আবাসনটি নির্মাণ করছে। ঐ আবাসন প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকরা জানান, এই প্রকল্পের সমস্ত ফ্ল্যাট বাড়ি ইতিমধ্যেই নাকি বিক্রিও হয়ে গিয়েছে। তাদের এখানে আর কোন ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য খালি নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কারা ওইসব ফ্ল্যাট গুলি কিনলেন, কোনও কাগজপত্র যাচাই না করেই। কালিগঞ্জ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গায়ে গড়ে উঠেছে এই বহুতল আবাসন প্রকল্পটি। দেখলেই বোঝা যায় – এটি সরকারি জায়গা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, “এই বহুতল প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে এখান থেকে প্রায় ৬০০ মিটার দূরে একটি জমির দাগ নম্বর দেখিয়ে, কিন্তু, স্থানীয় ওই তৃণমূল কংগ্রেস নেতার যোগসাজসে ও ভূমি ও ভূমি রাজস্ব বিভাগের দুই কর্মীর অনুপ্রেরণায় ও মোটা টাকার লেনদেনে ওই প্রোমোটার সরকারি ওই জায়গা দখল করে ইতিমধ্যে কয়েক কোটি টাকার ওই প্রকল্পটি কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন – কে বা কারা এই আবাসন প্রকল্পের মালিক তা কিছুতেই জানা যাচ্ছে না। স্বভাবতই তারা মনে করছেন ভূতে তৈরি করছে এই আবাসন প্রকল্পটি । অবাক করার বিষয় হল যারা ওই প্রকল্পে বাড়ি কিনেছেন তাদের টাকাও নাকি ভূতের একাউন্টেই জমা পড়ছে প্রতিমাসে ব্যাংক মারফত ট্রান্সফার হয়ে।”
এই সমস্ত অভিযোগ পাওয়ার পর ‘এই বাংলার’ তরফ থেকে ঘটনাস্থলে গিয়ে সরজমিনে তদন্ত করে জানা যায় – বিধাননগরের রাম মন্দিরের সামনে অবস্থিত একটি প্রোমোটারি সংস্থা নাকি ঐ বহুতল আবাসনটি নির্মাণ করছেন। ওই প্রকল্পের দুইজন মালিকের নাম জানা গিয়েছে। যদিও, ওই প্রকল্পের অফিসে গিয়ে তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক সুন্দরী মহিলা কর্মী শুধুমাত্র জানালেন – ‘স্যাররা এখানে আসেন মাঝে মাঝে। কিন্তু, কখন আসবেন, আর কখন যাবেন তা কেউ বলতে পারবে না বা আমার পক্ষেও বলা সম্ভব নয়।’ স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে এই দুই জ্যান্ত ভূতকে। তাদের আসল পরিচয়টাই বা কি? সূত্র মারফদ জানা গেছে, প্রায় প্রতিদিন রাত্রেই জেমুয়ার একটি অখ্যাত জায়গায় ওই দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল নেতার সাথে ওইসব প্রোমোটার ভূতরা নিয়মিত মদ্যপানের আসরেও নাকি বসেন ।