মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ- রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী’র ঘোষণা করা ‘দুয়ারে রেশন’ এখনো পৌঁছায়নি বটে, তবে, মাসের পর মাস অনাহার-অর্ধাহার, বিনা চিকিৎসার দাক্ষিণ্যে মরন সম্ভবত এবার সমন পাঠাচ্ছে শহরের ইস্পাত নগরীর ‘সান্যাল বুড়ি’র জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরের চৌকাঠে!
এই ‘সান্যাল বুড়ি’ কিন্তু বানের জলে ভেসে আসেননি এ শহরে। বলাভালো – তিনি এই শহরের ইস্পাত সমাজের একজন গৃহবধূ। আর ইস্পাত-কঠিন হৃদয়ের ইস্পাত প্রশাসন, দায়হীন ইস্পাত সমাজ ‘বুড়ি’র সিঁদুর মুছে যাওয়ার পর যখন তাকে এই আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, মুখ ফিরিয়েছেন কারখানার ‘হাম বড়াই’ শ্রমিক নেতারাও,’সান্যাল বুড়ি’র মুখে তখন দুমুঠো ভাতের জোগান দিচ্ছেন এক ‘অন্ধ দেবতা’। রাজ্য জুড়ে এখন ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বইছে বলে দাবি করছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও রাজ্য প্রশাসন। কিন্তু, প্রদীপের তলাতেই যে রয়ে গিয়েছে ঘন আঁধার- তার খোঁজ নেয় ক’জন ?
রাজ্য সরকারের উদ্যোগে গত দেড় বছর ধরে চলছে ‘দুয়ারে সরকার প্রকল্প’ আর দুবছর আগে থেকেই চলছে দুয়ারে রেশন। রাজ্যের বহু মানুষ এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকার পেয়েছেন কিন্তু ‘সান্যাল বুড়ি’র মতো এমন বহু মানুষ এখনো রয়ে গিয়েছেন দুয়ারের রুগ্ন চৌকাঠের ওপারের অসীম আঁধারে – যারা এই প্রকল্পের কোন সুবিধাই এখনো পাননি। এমনই এক মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক ঘটনার খোঁজ পাওয়া গেল দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর বি-জোন এলাকাতেই। দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর বি-জোন চিত্রালয় সংলগ্ন গান্ধী কলোনি বস্তিতে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বসবাস করছেন শিবানী সান্যাল নামক বছর সত্তরের এক প্রৌঢ়া বিধবা মহিলা। তার রেশন কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড থাকলেও সরকারের কোন প্রকল্পের কোন সুবিধাই তিনি পাচ্ছেন না জানা গেল। প্রায়শই অনাহারে দিন কাটছে ওই মহিলার, বলে স্থানীয় সূত্রে দাবি করা হয়েছে। দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর বি-জোন স্থিত চিত্রালয় সিনেমা হল সংলগ্ন গান্ধী কলোনিতে শিবানী সান্যাল এর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল – শারীরিক ভাবে অক্ষম, রোগগ্রস্ত বয়স্ক ‘সান্যাল বুড়ি’ বিছানায় পড়ে রয়েছেন ছ-সাত বছর ধরে। বললেন, “৩০ বছর ধরে ভাঙ্গাচোরা এই বস্তি বাড়িই আমার ঠিকানা। এখানে আমার আর কেউ নেই।” শিবানী সান্যাল এর সাথে কথা বলে জানা গেল মিশ্র ইস্পাত কারখানার প্রাক্তন কর্মী প্রয়াত রাজেন্দ্র নাথ সান্যালের স্ত্রী এই শিবানী। এলাকার লোকজন তাকে চেনে ‘সান্যাল বুড়ি’ বলেই। রাজেন্দ্রনাথ ১৯৮৮ সালের প্রথম দিকে মিশ্র ইস্পাত কারখানা থেকে অবসর গ্রহণ করার কয়েক বছর পরই মারা যান। অবসর গ্রহণ করার পর স্থানীয় তিলক রোডের কোয়াটারটি তিনি ইস্পাত সংস্থাকে ফেরত দিয়ে দিতে বাধ্য হন, কারণ তখন ইস্পাত কারখানার নিয়ম অনুযায়ী কোন শ্রমিককেই অবসরের পর আর কোয়াটারে থাকতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না। তাই, বাধ্য হয়েই তিনি তার কোয়ার্টারটি ছেড়ে স্থানীয় তিন নম্বর জল ট্যাংকি সংলগ্ন চিত্রালয় গান্ধী কলোনি বস্তিতে একটি কাঁচা মাটির বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। ইস্পাত কর্মীর পত্নী হওয়ার সুবাদে তিনি ইস্পাত হাসপাতালের একটি মেডিকেল কার্ডও পেয়েছিলেন। কিন্তু, পরবর্তীকালে ইস্পাত কর্তৃপক্ষ তাদের অবসর গ্রহণকারী সমস্ত কর্মী ও তাদের পরিবারবর্গের জন্য মেডিকেল কার্ডের সাথে সাথে মেডিকেল ইনসিওরেন্স শুরু করে দেন। এদিকে, মোটা টাকার খরচ করে অর্থ সম্বলহীন শিবানী সান্যাল তার দুই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান, ফলে, ইস্পাত সংস্থার মেডিকেল বীমার কার্ড তিনি করাতে পারেননি। তাই, ইস্পাত হাসপাতালের কোন সুবিধাই তিনি আর পান না।
রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি বা স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরাও তাকে বিধবা ভাতা বা স্বাস্থ্য সাথীর কার্ড করিয়ে দেননি বলে অভিযোগ শিবানী সান্যালের। তার রেশন কার্ড থাকলেও বাড়ি থেকে প্রায় দু কিলোমিটার দূরে রেশন দোকান হওয়ার ফলে তিনি সশরীরে রেশন দোকানে হাজির হতে না পারার দরুন দীর্ঘ ছয় বছর ধরে কোনরকম রেশনই তিনি আর পান না বলে অভিযোগ করেন। রাজ্য সরকার কিছুদিন আগে দুয়ারে রেশন প্রকল্পের নামে একটি প্রকল্প চালু করেছিলেন এই সমস্ত মানুষজনের কথা ভেবেই। কিন্তু শিবানী সান্যাল এর মতন বহু মানুষই এই প্রকল্পের কোন সুবিধাই যে পাননি এই ‘সান্যাল বুড়ি’ তার উজ্জ্বল উদাহরণ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত গৃহবধূদের জন্য লক্ষী ভান্ডার প্রকল্পও চালু করেছিলেন, কিন্তু, সেই প্রকল্পেরও কোনরকম সুবিধা পাননি শিবানী সান্যাল বলে তিনি জানিয়েছেন। একপ্রকার প্রায় অনাহারেই দিন কাটছে শিবানী সান্যাল নামক ওই বয়স্ক মহিলার।
কথাই আছে, ‘যার কেউ নেই তার ভগবান আছে’। চিত্রালয় গান্ধী কলোনি বস্তি এলাকারই বয়স্ক আদিবাসী ব্যক্তি জনৈক গুরুপদ মাজি। তিনি অন্ধ, কিন্তু নিজে শারীরিক ভাবে সক্ষম বলে নিজের রেশন টুকু এনে ওই বয়স্ক মহিলা শিবানী সান্যাল কে দুবেলা খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন ও দেখভাল করছেন মাতৃজ্ঞানে। নিজে অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ‘অন্ধ প্রশাসন’কে আলোর দিশা দেখাচ্ছেন গুরুপদ মাজি। এই সমস্ত ঘটনার কথা দুর্গাপুর মহকুমা শাসক সৌরভ চট্টোপাধ্যায় কে জানানো হলে তিনি বলেন, অবিলম্বে প্রশাসনের উদ্যোগে ওই মহিলার সাথে যোগাযোগ করে যথাযথ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হবে। সাথে সাথে কেন ওই মহিলা এখনো সরকারি কোন সুবিধা পাননি তাও খতিয়ে দেখা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। এখন প্রশ্ন হল শুধু কি শিবানী সান্যাল নাকি আরো অনেক মানুষজন এখনো এমন রয়ে গিয়েছেন, যারা রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের কোনরকম সাহায্য ছাড়াই অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন শিল্পাঞ্চলে? স্থানীয় বাসিন্দা অর্জুন মাহাতো জানান, “আমরা বহুদিন ধরে সান্যাল বুড়িকে এইভাবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিন কাটাতে দেখছি। বহুবার স্থানীয় নেতৃত্ব ও স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিদের অনুরোধ করেছি যাতে ওনার জন্য কিছু একটা করা হয়। কিন্তু – কে কার কথা শোনে! বাধ্য হয়ে নিজেদের স্বল্প রোজকার থেকে অল্প কিছু টাকা ও আনাজ দিয়ে সান্যাল বুড়িকে আমরা সাহায্য করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। অবিলম্বে সরকারের উচিত এই বয়স্ক মহিলার দিকে নজর দেওয়ার।”