মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:-
- সরকারের স্বার্থ দেখবে কে ?
- ‘সরকারের লোক।’
- ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখবে কে ?
- ‘যিনি বেওসায়ীদের মাথা।’
এই তো সহজ সোজা উত্তর। কিন্তু, জট বাস্তবে পাকায় ঠিক তখনই, যখন তিনি – একই দেহে যিনি ব্যবসায়ী আবার রাজ্য সরকারের একটি সংস্থার ‘মেজ মাথা’, তাই সবেতেই তার নাকটি তিনি গলাবেন, অথচ ধাক্কাটা লাগবে শেষে তার সরকারি সংস্থারই গায়ে। কারণ- একই দেহে সবটা ধারণ করতে থাকা বহুরূপী যে সবসময় ‘ঠাকুর’ই হবেন, তার নিশ্চয়তা থাকে না। কিন্তু, ময়দানবের ‘খুড়তুতো ভাই’ হয়ে তিনি সর্বত্র ইচ্ছেমতো ‘তাণ্ডব’ চালাতে গিয়ে আদতে যে সরকারের মুখেই চুনকালি লেপে নিজের হিসেব ঠিক রাখতে চাইবেন, তার জ্বলজ্ব্যান্ত নজির সম্প্রতি হাতের মুঠোয় পেয়ে কার্যত ‘থম্’ মেরে গেছে রাজ্য সরকারের আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এডিডিএ)। এডিডিএ’র ওপর তলা থেকে চাপরাশি মহল, গত কয়েকটি দিন গুনগুন করছে একটিই গুঞ্জন- “পারে বটে লোকটা! সাপ হয়ে কাটবেও, ওঝা হয়ে ঝাড়বেও। এই না হলে পাক্কা বেওসায়ী। আসলে, এরা কারো ‘বাবা’র নয়। এরা তক্ষুনি দিদি’র তো তক্ষুনি ফের দাদা’র। মাঝখান থেকে বারোটা বেজে যাচ্ছে এডিডিএ’র সবকটা ঘড়িতে।”
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ ধন্য শহর দুর্গাপুরের ব্যবসায়ী কবি দত্ত গত কয়েক মাস যাবৎ এডিডিএ’র ভাইস চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করে বসেছেন। কেন তিনি-ই, তা এতদিন কেউ জানতেন না, তবে এডিডিএ এবং শহরের বণিকমহল এবার সম্ভবতঃ ঠাহর করছেন – ‘আদতে কবি একজন ব্যবসায়ী তায় আবার বণিক সভার ওপরতলার লোক। তাই, সরকারের স্বার্থ পরে, আগে তিনি দেখবেন বেওসায়ীদের স্বার্থটাই।’ আবার, সে স্বার্থরক্ষার নেপথ্যে তার ‘আলাদা রকম’কোনো অঙ্ক থাকলেও এডিডিএকে হয়তো বা পাঁচ ইঞি ব্যাকফুটে যেতে হতেও পারে। তাতেও কবির ‘কুছ পরোওয়া নেহি।’ কবির নিজস্ব নিয়মে সবই যেন দারুন ছন্দে সাজানো!
প্রসঙ্গঃ মামড়া বাজারের মুরগী ব্যাবসায়ী বাপি সরকার ওরফে ‘চিকেন বাপি’র ব্যাবসাকেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের বাহুবলী হামলা। অভিযোগ,প্রাক্তন কাউন্সিলর লাভলী রায়ের লোকজন নাকি চিকেন বাপি’র তথাকথিত প্রতিষ্ঠানে জবরদস্ত হামলা চালায়, গত ২১ফেব্রুয়ারি।
ঘটনা ঘটতে দেরি, বণিক কবির সদলবলে সটান টোকা দুর্গাপুরের মহকুমা শাসকের দরজায়। ইস্যু – ‘ব্যাবসায়ীর ওপর এই আক্রমণ মানা যায় না। বিহিত চাই।’
কবি দত্ত মহকুমা শাসককে জানালেন – কিভাবে, রাজনৈতিক ঝাণ্ডা হাতে ‘দুষ্কৃতী’রা ‘চিকেন বাপি’র ব্যবসাস্থল তছনছ করে দিয়েছে। একটি ভিডিওতে তাকে বলতে দেখা যায়- ‘নাম না করে যা বলার সব বলেছি।’ বণিক সাভার আরেক দলপতি, প্রাক্তন কাউন্সিলর রমাপ্রসাদ হালদার বলেন, “জবরদখল হঠানোর নামে কিছু লোক বাপি সরকারের প্রতিষ্ঠানে হামলা চালালো, আইন হাতে নিয়ে। তার জবরদখল আছে কিনা – তা দেখবে সরকারি সংস্থা। ঝাণ্ডা নিয়ে কেউ এসব করতে পারে না। তাই, আমরা মহকুমা শাসকের হস্তক্ষেপ চেয়েছি।” রমা নিজে শাসক তৃনমূল কংগ্রেসের লোক হলেও, অন্য একটি ভিডিওতে কবি সাফ জানিয়ে দেন – ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের লোক নই ‘
অর্থাৎ, সোজা কথায়- শহরের বণিকেরা একজন সতীর্থ ব্যবসায়ীর স্বার্থে দলবদ্ধ হয়ে মহকুমা শাসকের দ্বারস্থ হলেন। ‘চিকেন বাপি’র জমি, পুকুর আদপে বৈধ নাকি জবরদখল, তা দেখার দায় বাপি’র ‘বণিক বন্ধু’দের নয়। প্রশ্ন- দায় কি নয় তবে শ্রীযুক্ত কবি দত্তরও ? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহের পরশে শেষে এডিডিএতেও কি তবে ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে’ ? – এ প্রশ্ন ওঠা অপ্রত্যাশিত নয়। শহরে যার ভরা ব্যবসা, তারই হাতে শাসনভার দিলে কি তবে বিচারের ধরনটাও অন্য রকমের হয়? খানিকটা পাতে ঝোল টানার মতো ? বিশেষ করে জবরদখলে অভিযুক্ত ‘চিকেন বাপি’ যখন আবার কবি দত্তর সাথে কোটি কোটি টাকার ব্যবসায় যুক্ত ? “আমার আর কি বলার আছে ? সাধারণ মানুষ তো সবই দেখছে। ভাবছি শুধু- সরকারও নিশ্চয় দেখছে সবকিছুই,” বললেন প্রাক্তন কাউন্সিলর লাভলী রায়। তিনি আরো বলেন, “আমার যা কিছু জানানোর প্রশাসন, দল, পুলিশ- সকলকেই জানিয়েছি। উত্তরটাও সবার জানা।”যে উত্তর নাকি ‘সবার জানা’, তা নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাইলেন না লাভলী।
বাপি সরকারের ‘ জবরদখল ‘ করা জমি, ব্যবসাস্থলে হামলা আর কবি দত্তের দরবার করা প্রসঙ্গে দুর্গাপুরের মহাকুমা শাসক সৌরভ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “হ্যাঁ। ওঁরা এসেছিলেন। ওঁদের কথাও শুনেছি। গোটা বিষয়টা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”