মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- নিজের হোটেলে মুরগীর যোগান ঠিক রাখতে এক ‘জবরদখলকারী’র তাঁবেদারি করতে গিয়ে কি এবার এডিডিএ’র সাথে সরাসরি সংঘাতের পথে রাজ্য সরকারি সংস্থাটির ভাইস চেয়ারম্যান? নাকি, মামড়ার বিতর্কিত জবরদখলকারী ‘চিকেন বাপি’র পাশে দাঁড়িয়ে কবি দত্ত এডিডিএ কেই বার্তা দিলেন – ‘বুঝে শুনে কাজ করতে হবে। জবরদখল একান্তই হঠাতে হলে, বড়জোর ফুটপাতিয়াদের উচ্ছেদ অব্দি ঠিক আছে। শহরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের দোকান-মকান, হোটেল- পানশালার দিকে এডিডিএ যেন ফিরেও না তাকায়!’
তিন সপ্তাহ আগে শহরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় জবরদখল উচ্ছেদের জন্য কোমর বাঁধে রাজ্য সরকারের পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের অধীনস্থ আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এডিডিএ)। সেই মোতাবেক কখনো বিধাননগর, কখনো সিটি সেন্টারে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু উচ্ছেদ চালানোও হয়। সবই অবশ্য সড়কের ধারে ফুটপাত সাফ করার মতো! কিন্তু, সরকারি জমির উপর প্রায় পাকাপোক্ত ব্যবসা কেন্দ্র ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে ফিরেও তাকায়নি এডিডিএ। এরই মাঝে, স্থানীয় নিউ টাউনশিপ থানা এলাকার মামড়ায় দীর্ঘদিন ধরে গজিয়ে ওঠা একটি মুরগীর মাংস প্রস্তুতকারী সংস্থার জবরদখলের দিকে নজর পড়ে সংস্থার ফিল্ড অফিসারদের। বিষয়টি দু’বার এডিডিএ’র ঊর্ধ্বতন কর্তাদের নজরে আনা হলেও, অজ্ঞাত কারণে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। ‘চিকেন বাপি’ নামে পরিচিত স্থানীয় বাপি সরকারের ওই সংস্থা ঘটনাচক্রে এডিডিএ’র ভাইস চেয়ারম্যান কবি দত্তের সমস্ত হোটেলে বছরের পর বছর ধরে মুরগী সরবরাহ করে আসছে। সন্দেহ দানা বাঁধে ‘এডিডিএ’র ভাইস চেয়ারম্যানের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে বলেই কি ‘চিকেন বাপি’র দখলদারি নিয়ে এডিডিএকে উচ্ছেদে যেতে রুখে দেওয়া হয়েছে? সম্ভবতঃ এই সন্দেহ থেকেই এলাকায় জনরোষ দানা বাঁধে। যার জেরে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এলাকার বিক্ষুব্ধ বাসিন্দারা ‘চিকেন বাপি’র ব্যবসাস্থলে হামলা করে বিস্তর ভাংচুর চালায়। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় পাকা দেওয়াল, মেশিনপত্র। বাপি সরকার বলেন, “ওরা আমার এখানে তাণ্ডব চালিয়ে প্রায় ৫ লক্ষ টাকার মেশিনপত্র চুরমার করে দিয়েছে। আমি জানি, এসবের পিছনে এখানকার কোনো ছোটখাটো, মাঝারি লোক নেই। এসবের পিছনে খুব ‘বড় মাথা’ রয়েছে, যার যোগাযোগ খুব ওপর মহল পর্যন্ত। আমার সাথে তার এসব করার ‘আসল কারণ’ অন্য। সবার সামনে বললে কাল আমাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলবে।”
‘চিকেন বাপি’র তথাকথিত ব্যবসা কেন্দ্রে হামলা কি রাজনৈতিক মদদপুষ্ট? বাপি সরকার বললেন, “দেখুন, আমার এখানে যখন লোকেরা তাণ্ডব চালালো, তখন আমি নিজে এখানে ছিলাম না। শুনেছি, ওরা সবাই এলাকারই লোক। এসে দেখি আমার জমি, পুকুর, কারখানার চারপাশে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি- এই দুই দলেরই ঝান্ডা লাগিয়ে দিয়ে গেছে। আবারো বলছি – এসবের পিছনে ‘বড় মাথা’ রয়েছে। সে আমাকে সরিয়ে দিতে চায়। আমাকে সরালেই যে তার লাভ!”
বারবার ‘চিকেন বাপি’ একটি ‘বড় মাথা’র কথা বলছেন, কিন্তু, তার নামটা মুখে আনতে তার ভীষণ আতঙ্ক! কে সেই বড় মাথা? ‘চিকেন বাপি’কে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে পারলে লাভটাই বা কার? যদি লাভই হয় – সেটা রাজনৈতিক লাভ নাকি অর্থনৈতিক, নাকি সম্পত্তিগত লাভ? বাপি সরকার বলছেন- “পুলিশ- প্রশাসন নিরপেক্ষ তদন্ত করে দেখুক। আমি এখন আর বেশি কিছু বলছি না!” গোড়ায় ‘বাপি’র আড়তে তাণ্ডব চালানোর নেপথ্যে এলাকার প্রাক্তন কাউন্সিলর লাভলী রায়ের নাম ওঠে। ঘটনা চারদিন পর বণিক সভার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে নিয়ে মহকুমা শাসকের দপ্তরে দরবার করেন কবি দত্ত। দাবি তোলেন, ‘ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে হামলার বিহিত করতে হবে।’
এডিডিএ’র অন্দরমহলে এরপরই তীব্র অস্বস্তি ছড়ায়। কারণ, ‘চিকেন বাপি’ র পাশে দাঁড়ানো কবি দত্ত যে আবার এডিডিএ’রই ভাইস চেয়ারম্যান। এডিডিএ’র দাবি, “চিকেন বাপি’র পুরো জমিটাই জবরদখল। তার পাশে ভাইস চেয়ারম্যান দাঁড়ালে সংস্থার মান ইজ্জত আর কিছু থাকবে? ভাইস চেয়ারম্যান ‘চিকেন বাপি’ ইস্যুতে লুকোচুরি খেললেও, বিষয়টিতে কোন রাখঢাক না করেই এডিডিএ’র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবারই জানিয়ে দেন, “কে কার পাশে দাঁড়ালো, সেটা আমাদের কাছে আদৌ কোন বিচার্য বিষয় নয়। সরকারি সংস্থা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তার কাজ করবে। বেআইনী জবরদখল উচ্ছেদ চলবেই। এখানে কারো পছন্দ-অপছন্দ কোন ইস্যুই নয়।” পাশাপাশি, চেয়ারম্যান আরো স্পষ্ট করে বলেন, “অনেক সময় সরকারি কাজে কিছুটা সময় লাগে। তার মানে এই নয় যে সরকার হাত গুটিয়ে বসে গেল। আমরা সরকারি জমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আমাদের নির্ধারিত কাজে অবিচল থাকবো। মামড়ার ‘চিকেন বাপি’র জবরদখল সরাবোই।”
রাজ্য সরকারি সংস্থা এডিডিএ’র যখন এত স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট মনোভাব, সেখানে জবর দখলের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে প্রশাসনের কাছে দরবার করে দুর্গাপুরের কবি দত্ত কি তারই সংস্থা এডিডিএ’র সাথে এবার সরাসরি সংঘাতের পথে?- এ প্রশ্নই শহরে এখন মাথা চাড়া দিচ্ছে।