মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- উত্তর প্রদেশের কুখ্যাত গ্যাংস্টার আমন সিং-ই কি তাহলে কয়লা মাফিয়া রাজু ঝা খুনের নেপথ্যে থাকা আসল ‘সুপারি কিলার’? পূর্ব বর্ধমান পুলিশের তদন্তকারী আধিকারিকদের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি কিন্তু সেই রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে জল্পনা আরো পোক্ত হয়েছে পূর্ব বর্ধমান পুলিশ সুপারের সরাসরি ঝাড়খণ্ডের একটি জেলখানায় আমন সিং-এর ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার পর থেকে। পুলিশ সুপার কামনাশিষ সেন ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ কেন্দ্রীয় কারাগারে আমনের তত্ত্বতালাশ করতে ফোন করেছিলেন গত শনিবার বলে সুত্র মারফত জানা গেছে ।
পুলিশেরই অন্য একটি সূত্র জানায়, শুধুই হাজারিবাগ নয়, গত দু দিনে ঝাড়খণ্ডেরই রাঁচি এবং বিহারের পাটনা কেন্দ্রীয় কারাগারেও আরো কয়েকজন দাগী অপরাধীর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। সূত্রটি জানায়, আমন সিং রাজু খুনের সুপারি নিলেও, হাজারিবাগ জেলখানার ভেতর বসে এই অপারেশন চালানোর জন্য বিহার অথবা ঝাড়খণ্ডের বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে সে দক্ষ শার্প শ্যুটার ভাড়া করেছিল। তাদেরই দুজন রাজু ঝা এর ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় শক্তিগড়ে। এই শার্প শ্যুটারদের খোঁজেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান মোতাবেক আঁকা স্কেচ পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন জেলে এই উদ্দেশ্যেই, যে – তারা কতদিন জেলে ছিল, কোন অপরাধে চালান হয়, কতদিন হল তারা বাইরে বেরিয়েছে এসব তথ্য যাতে মেলে।
পাশাপাশি, রাজুর ঘনিষ্ঠ তো বটেই, তার সাথে সম্প্রতি মনোমালিন্য হয়েছিল এমন লোকজনের, বিশেষত: কয়লা কারবারিদের তালিকা তৈরি করে একে একে জেরা করাও শুরু করেছে পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ। গতকালই এমন এক কারবারি প্রিন্স সিং-কে জেরা করেন তদন্তকারী অফিসারেরা। “তালিকায় অন্তত একশ জনের নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে। তালিকাটি আরো লম্বা হতে পারে,” বলে এক আধিকারিক জানান। তিনি আরো জানান, “ওদের কেউ কেউ এখন কলকাতায়, কেউ বা দক্ষিণ ভারতে রয়েছে।”
দুর্গাপুরের কয়লা মাফিয়া রাজেশ ঝা ওরফে রাজুকে গত ১ এপ্রিল বর্ধমানের জাতীয় সড়কের ধারে শক্তিগড়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় একটি নীল ব্যালেনো গাড়িতে চেপে আসা দুষ্কৃতীরা। সোমবার সন্ধ্যায় লিক্ হয়ে যাওয়া একটি ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায় ওই নীল গাড়ি থেকে দুই দুষ্কৃতী নেমে, বিনা উত্তেজনায় রাজু ঝাকে পরপর গুলি চালিয়ে ঐ গাড়িতে চেপেই চম্পট দেয়। এলাকা ছাড়ার আগে, তারা রাজুর মৃত্যু নিশ্চিত করতে ফের দু রাউন্ড গুলি চালায়, তার বুকে। গোটা অপারেশনটা ছিল ৩০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের।
রাজু ঝা’র মতো বড় মাপের কয়লা মাফিয়া খুন হতে না হতেই তীব্র চাঞ্চল ছড়ায় দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে। বাড়ে রাজনৈতিক উত্তেজনাও। কারণ, একসময়ের সিপিএম – ঘনিষ্ঠ রাজু ২০২১ এর বিধানসভা ভোটের মুখে তার পুরনো সঙ্গী এক পুলিশ অফিসার শঙ্খ বিশ্বাসকে সাথে নিয়ে তৎকালীন রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের হাত ধরে দুর্গাপুরেরই পলাশডিহা মাঠে দলের যোগদান মেলায় গেরুয়া শিবিরের যোগ দেন। রাজু ঝাকে সাথে নিয়ে শহর জুড়ে তখন কয়েক দফা বাইক মিছিলও করে বিজেপি। সারা শহর তখন ‘আমরা রাজূদার অনুগামী’ পোষ্টারে ছেয়ে যায়। রাজু নিজেও শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। স্বাভাবিক ভাবেই, রাজু হত্যাকাণ্ডের সাথে রাজনৈতিক তরজাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। যদিও, এই খুনের সাথে সরাসরি রাজনৈতিক যোগের সম্ভাবনা এখনো অব্দি মেলেনি, বলেই পুলিশের পদস্থদের একাংশের দাবি।
তাহলে, সেই রাজু ঝাকে এত নির্মমভাবে কে বা কারা মারল? কেনই বা মারল এত নৃশংসভাবে ? – এই প্রশ্নের জবাব এখনো তদন্তকারীদের হাতে নেই। নেই বলেই ১২ সদস্যের তদন্তকারী দল ইতিমধ্যেই বিহার, ঝাড়খণ্ড সহ এ রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম এবং মুর্শিদাবাদের বহু জায়গায় ছাপা মেরেছে। কিন্তু, এক আধিকারিকের কথায়, “এখনো অব্দি এই খুনের মোটিভ কি তা স্পষ্ট হয়নি।”
মোটিভ স্পষ্ট হয়নি ঠিকই, তবে, কে বা কারা সুপারি নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করল, তা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা তদন্তকারীদের তৈরি হয়েছে। আর সেই কারণেই, পুলিশ সুপার কামনাশিষ সেন সরাসরি হাজারিবাগের জেল সুপারকে ফোন করে আমন সিং-এর বিষয়ে নাকি খোঁজখবর নিচ্ছেন।
কে এই আমন সিং?
উত্তর প্রদেশের খুনখার, দাগী অপরাধী এই আমন। তার মূল পেশাই হল- সমাজের বিভিন্ন পেশার অর্থবান লোকেদের কাছ থেকে মাসে মাসে, কখনো বা একলপ্তে ‘রংদারি ট্যাক্স’ আদায় করে নিজের ‘গিরোহ’ পালন করা।
ধানবাদ শহর এবং তার আশেপাশের কাতরাস, ব্যাঙ্ক মোড় এলাকা, দুমকাতে আমানের নৃশংস হত্যার বেশ কিছু নথি পুলিশের হাতে আসে। তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই, ‘রংদারি ট্যাক্স’ দিতে অস্বীকার করা ব্যক্তিদের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল এই আমান ও তার শার্প স্যুটারেরা। গত ২০১৭ এর মে মাসে ধানবাদ নগর পালিকার ডেপুটি মেয়র নিরাজ সিংকে ৬৭ বুলেটে ঝাঁঝরা করে আমান সিং-এর গ্যাং। নীরজের সাথে তার বাড়ীর সামনেই পরপর গুলিতে খুন করা হয় তার বডিগার্ড ও নীরজের আরেক সঙ্গীকেও।
তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়- জেলবন্দী আমন সিং কেন রাজু ঝাকে হত্যা করবে ? রাজুর সাথে কি তার ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল, নাকি রাজুকে দুনিয়া থেকে সরাতে আমনকে কেউ সুপারি দিয়েছিল ?