জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জীঃ- গণতন্ত্রের উৎসব কি শেষ পর্যন্ত মৃত্যু উৎসবে পরিণত হচ্ছে? অতীতের ঐতিহ্য বজায় রেখে পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষ্যে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে তিনটি মৃত্যুর ঘটনা এই প্রশ্ন তুলে দিল শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে। দেশের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবীদের আত্মাহূতি ছিল গর্বের বিষয়। কিন্তু গণতন্ত্রের উৎসবের জন্য মৃত্যুবরণ তো চরম লজ্জার! এই লজ্জা কি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের আছে? তারা তো ক্ষমতা দখলের স্বার্থে নির্লজ্জের মত নিহত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ব্যস্ত। এতে কি নিহতরা ফিরবে!
অবস্থানগত বদল হলেও পঞ্চায়েত বা পুরভোটের মত স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো সর্বদাই শাসকদলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ করে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতা থাকলেও সব ক্ষেত্রে নয়। অনেক সময় বিরোধী দলগুলো প্রার্থী পায়না এটা যেমন সত্যি তেমনি অনেক সময় শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অনেকেই প্রার্থী হতে ভয় পায় এটাও প্রমাণিত সত্য। স্বাধীনতার পর থেকে এইরাজ্যের প্রতিটি নির্বাচনে এই পরম্পরা চলে আসছে। একে রোধ করার জন্য শাসক ও বিরোধী দলগুলোকে কখনোই যৌথভাবে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে দেখা গেলনা। পরস্পরের দিকে আঙুল তুলতে তারা ব্যস্ত থেকে গেল। অথচ হিংসা রোধের দায়িত্ব সবার।
এই রাজ্যের দ্বিতীয় দুর্ভাগ্য হলো এখানে উন্নয়নের পরিবর্তে ব্যক্তিগত কুৎসার উপর নির্ভর করে ভোট হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে সেটা অতীতের সব নজির অতিক্রম করেছে। গত বিধানসভা ভোটের সময় থেকে প্ররোচনামূলক বাক্য বন্ধনীর ব্যবহার খুব বেড়ে গেছে। এবার হঠাৎ দেখা গেল মোটা অথচ ছোট ছোট বাঁশের টুকরো ও তার উপর একটা রাজনৈতিক দলের পতাকা এবং সঙ্গে প্রবীণ আইনজীবীর হুমকি- প্ররোচনার পক্ষে যথেষ্ট। তথ্য ও প্রমাণিত সত্যের পরিবর্তে প্রচারিত মিথ্যের উপর বেশি নির্ভরশীলতা বিরোধীদের সাফল্যের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। অথচ শাসক দলের একশ্রেণীর নেতার দুর্নীতি ও দৌরাত্ম্য সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে।
যাইহোক বিরোধী দলগুলোর আশঙ্কা ছিল রাজ্যের শাসকদল হয়তো ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে তাদের প্রার্থী দিতে দেবেনা। কিন্তু নির্বাচন কমিশনারের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ পঞ্চায়েতের আসনে প্রার্থী দিয়েছে। জেলা পরিষদের সবকটি আসনে এবং পঞ্চায়েত সমিতিতে প্রায় নব্বই শতাংশ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। সিপিএম ও কংগ্রেস তাদের বর্তমান সাংগঠনিক ক্ষমতা অনুযায়ী প্রার্থী দিয়েছে। ভাঙরে অশান্তির খবর থাকলেও প্রায় সর্বত্র কড়া পুলিশ প্রহরায় মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। অবশ্যই চাপা আতঙ্ক ছিল।
এরপর আছে মনোনয়নপত্র পরীক্ষা, প্রত্যাহার ও চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ। অর্থাৎ প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার পর শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নাটক। দেখার বিষয় হলো শাসক দলের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে কতজন বিরোধী লড়াইয়ের ময়দানে থাকে। চূড়ান্ত পরিণতির জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
ভোটের ফলাফল যাইহোক মানুষ কিন্তু শান্তি চায়। অশান্তি আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতালোভী নেতাদের হাত ধরে। পরস্পরের দিকে অভিযোগের আঙুল না তুলে এলাকায় শান্তি বজায় রাখার জন্য দলগুলোকে সচেতন হতেই হবে। শাসক দলের দায়িত্ব বেশি হলেও বিরোধী দলগুলো কিন্তু তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেনা।