সঙ্গীতা চ্যাটার্জী (চৌধুরী)ঃ- অনেক সময় আমাদের মনে নানান রকম প্রশ্ন জাগে। যেমন অনেকেই বলেন যে, কোনো আত্মীয়-স্বজন বা পিতৃ পুরুষ মারা গেলে তাঁর তর্পণ করা উচিত। আবার কেউ কেউ বলেন তর্পণের পরিবর্তে দুঃস্থ লোকের সেবা করা উচিত। এখন এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন ওঠে যে, মৃত ব্যক্তির তর্পণ না করে দুঃস্থ লোকের সেবা করলে তা ফলদায়ক হয় কিনা?
স্বামী সোমেশ্বরানন্দ মহারাজ বলেছেন যে, “তর্পণ হলো শ্রাদ্ধের অঙ্গ। প্রয়াত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা বা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার শান্তি কামনা করা হয়। কাউকে ফোন করা হলে যেমন আপনার শব্দতরঙ্গ আকাশপথে গিয়ে সেই বন্ধুর ফোনে পৌঁছে যায়। সেইরকম আপনি প্রার্থনা করলে সেই প্রার্থনার দ্বারা আপনার চিন্তাতরঙ্গ প্রয়াত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যাবে।” এই তর্পনের ফল প্রসঙ্গে স্বামী সোমেশ্বরানন্দ মহারাজ আরো বলেছেন যে, “এই প্রার্থনায় রোগ নিরাময়ে সাহায্য হয়,একথা পাশ্চাত্যের কিছু হাসপাতালে পরীক্ষা করে দেখা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ওই ব্যক্তির সংস্কার বা কর্মফলই প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুরা যেমন তর্পণ করে, খ্রিস্টানরা তেমনি চার্চে গিয়ে প্রার্থনা করে, মুসলমানেরা ওই ব্যক্তির কবরে গিয়ে ধর্মগ্রন্থ পড়ে। দুঃস্থ লোকদের সেবা করাও ভাল, ফলদায়ক।”
এখন কোনো ব্যক্তি এই দুটোর মধ্যে কোনটা বেছে নেবেন সেটা কি করে ঠিক করবেন? এবিষয়ে মহারাজ বলেছেন যে, “আপনি কি করবেন -তর্পণ না সেবা অথবা দুটোই-সেটা আপনি ঠিক করুন। অনেক ধর্মীয় আচার-প্রথা তৈরি হয়েছে সামাজিক ঐক্য বা ডিসিপ্লিনের জন্য। অন্যান্য কারণও আছে। এবিষয়ে উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করেছি “ধর্ম কুসংস্কার ও লোকাচার” বইয়ে। এবিষয়ে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমার বন্ধুস্থানীয় আবদুল যোগ দিয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনে। সে যখন ব্রহ্মচারী, তার বাবা মারা যান। তখন মিশনের প্রেসিডেন্ট স্বামী বীরেশ্বরানন্দ মহারাজ তাকে জিজ্ঞেস করেন শেষকৃত্য বিষয়ে। আবদুল বলে যে তার আগ্রহ নেই বাবার শেষকৃত্য করার। মহারাজ উত্তর দেন, তোমার বাবা মুসলমান ছিলেন বলে তার কথা মনে রেখে তুমি ইসলাম অনুযায়ী প্রথা পালন করে তোমার দায়িত্ব পালন করো। সাধুদের বলো এই কাজে কি কি জিনিস চাই, তারা যোগাড় করে দেবেন। অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু কাজ করতে হয়। এই কাজে যদি কারোর ক্ষতি না হয়, তবে পারিবারিক শান্তি বজায় থাকে। কখনও কোনো প্রথা অযৌক্তিক হলেও প্রথা হিসেবে করতে হয়। যেমন অফিসে, পার্লামেন্টে, ক্লাবে মৃতব্যক্তির উদ্দেশ্যে শোক প্রকাশ করা হয় দাঁড়িয়ে। বাস্তবে শোকার্ত মানুষ বসে বা শুয়ে পড়ে। তাহলে পার্লামেন্টে দাঁড়ায় কেন? নিছক প্রথা হিসেবে।”
সবশেষে মহারাজ বলেন, “আপনি বাড়িতে বিরাটভাবে শ্রাদ্ধ না করে নদী বা গাছের নীচে সংক্ষেপে তর্পণ করে পুরো অর্থ গরীবদের সেবায় লাগাতে পারেন।”