মনোজ সিংহ, দুর্গাপুরঃ– মাটির ওপরে সেই রয়েই গেল ‘বুঁদির কেল্লা’। প্রভাবশালীদের ধমকিতে হূমকিতে কি তবে শেষে গুটিয়েই গেল এডিডিএ ? ডজন ডজন ফুটপাতের গরিবের ‘ভাতের হাঁড়ি’তে বুলডোজার চালিয়ে, ধনীর দুলালদের আমোদ প্রমোদের বিলাসবহুল ক্লাব ঘর আর শাসকদলের এক নেতার জবরদখলকারী পোষ্যদের কাছে এসে মাথা নুইয়ে এডিডিএ র মুখে কালি মাখালেন রাজ্য সরকারি সংস্থাটির দুর্বল চিত্তের দু- চারজন আধিকারিক ?
বিস্তর তর্জন-গর্জন করে পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজ সাজিয়ে বহু বছর পর দুর্গাপুরের নগর কেন্দ্র সিটি সেন্টার এর জবরদখল উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছিল আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এডিডিএ)। কিন্তু, ময়দানে নামার আগেই এডিডিএ’র আমলা মহলে এক প্রভাবশালী কলকাঠি নাড়া শুরু করেন কার্যতঃ পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আকস্মিক বরদানে বেওসায়ী থেকে আচমকা কেউ কেটা হয়ে ওঠা ওই তথাকথিত প্রভাবশালীই সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়বেন সিটি সেন্টারের জবরদখল উচ্ছেদ অভিযান সফল হলে। তিনি বেকায়দায় পড়বেন দু তরফা কারণে। প্রথমতঃ ব্যক্তিগত, দ্বিতীয়ত তেনার সামাজিক ইমেজ বিপণনে। প্রথম কারণটির নেপথ্যে রয়েছে সিটি সেন্টারের জায়গায় জায়গায় সরকারি তকমা ব্যবহার করে তার নিজের জবরদখল। দ্বিতীয় কারণটি হল- এধার ওধার থেকে পকেট গরম করতে পারলেও, পয়সার গদিতে হাসিমুখে বসে থাকা লোকটার সামাজিক সম্মান তথা প্রতিপত্তি বিশেষ ছিল না । মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎ আদরে তার আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হতেই সেই ‘নতুন বামুনের’ চারপাশে বেঁটে বামুন, খাটো বামুন, ঢ্যাঙ্গা বামুন, শুটকো বামুনদের ভিড় রাড়তে শুরু করে। সিটি সেন্টারে তার নয়া আবতারে নতুন বামুন বেশ গুছিয়ে নতুন ত্রাতা সেজে যখন প্রায় বসতে চলেছে, তখনই এডিডিএ ভাঙ্গার গানের ক্যাসেট চাপাতেই তার গেল গেল রব। পাড়ার দাদা বলে বলে কথা! প্রেস্টিজ বাঁচাতে নতুন বামুনের ফোন সরাসরি এডিডিএর এখানকার এক কার্য্যনিবাহীকে। আমলার কর্তব্য ভুলে এডিডিএ র মুখ্য কার্য্যনিবাহী আধিকারিক অভিজিৎ সামন্ত সরাসরি অধীনস্থদের হুকুম করে ভাঙচুর চালানোর রুট বিনা নোটিশে বদলে দিলেন পরপর দুদিন এমনই কৌশলে, যাতে সিটি সেন্টারের ‘প্রচেষ্টা’ নামের বিতর্কিত বিলাসবহুল ক্লাব ঘরটির গায়ে এই উচ্ছেদ অভিযান পর্বে আঁচড়টুকু না লাগে বলে অভিযোগ। হলও তাই, প্রথম দিন ভাঙ্গা পর্ব থামল প্রচেষ্টা থেকে ৩০০ মিটার দূরে সিটি ক্লাব মোড়ে, কয়েকটি ধাবা, ঘুমটি ভেঙে। প্রথম দিনের কাজ যেখানে থামে, নিয়ম মোতাবেক দ্বিতীয় দিনের কাজ শুরু হয় ঠিক সেখান থেকেই। কিন্তু, উলটপুরানে ভরা এডিডিএ তে ঐ বামুনের সাসানিতে জড়সড় দুর্বল চিত্তের বর্তমান প্রশাসন নতুন বামুনের ‘ভয়ে’ দ্বিতীয় দিনেও রুট ঘুরিয়ে কাজ শুরু করল সিটি সেন্টারের কবিগুরু মোড় থেকে। দুটি দিনেই কর্মী বর্গ ‘যাচ্ছি-যাবো’ ভাবে যথেষ্ট সময় ব্যয় করে কাজ শুরু করে, যথারীতি থেমে যায় ‘প্রচেষ্টা’র কয়েক ইঞ্চি দূরে । সময় নাকি শেষ!!
মাঝে যদিও বাধসাধে প্রকৃতিক দুর্যোগ। এটাই এখন সরকারি পর্যায়ে ঢাল এডিডিএ’র। অথচ, বছরের পর বছর ফুটপাতে দুটো ডাল-ভাত ফুটিয়ে, পাইস হোটেল চালিয়ে যারা সংসার চালায়, নোখ দাঁত বের করে এডিডিএ’র বুলডোজার তাদের কুঁড়ে ঘর ধুলোয় মিশিয়ে দিতে মুহূর্ত কাল বিলম্ব করেনি। “ওইসব গরিবের দোকান ঘর ভাঙতে এডিডিএ’র বাহুবলী কর্মীরা দিনভর তর্জন-গর্জন করে পেশী ফুলিয়েছে আর সূর্যকে খোঁচা মেরে অস্তাচলে ঠেলে দিয়ে, সুড় সুড় করে প্রচেষ্টার চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে দুটি দিনই। কারণ, ওটাই নাকি এখন নতুন বামুনের কওার কাছে পৌঁছানোর অন্যতম ঠাকুর দালান”, মন্তব্য জেলা কংগ্রেস সভাপতি দেবেশ চক্রবর্তীর। সিপিএম নেতা শ্যামা ঘোষ বলেছেন, “গরিবের ওপর বুলডোজার চালিয়ে বড়লোকদের তোষামোদ করার এডিডিএ’র এই নোংরা খেলা সবাই তো দেখতে পেল!”
এডিডিএ ঠিক কেন এমনটা করল ? এডিডিএ একটি ক্লাব ঘর ভাঙলো কি ভাঙলো না সেটা ততক্ষণ পর্যন্ত বড় ইসু নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত এর নেপথ্যে ষড়যন্ত্রের অন্তরঘাত ছিল না। কি কারনে এত গুরুত্বপূর্ণ এই একটিমাত্র ক্লাব ঘর যার জন্য সংস্থার চেয়ারম্যান বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করেন-“জবরদখল উচ্ছেদ শুরুটাই করা হবে ঐ প্রচেষ্টা ভেঙে।” আর তারপরও ক্লাবঘরে বুলডোজার পৌঁছানোর আগেই ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটা ছুঁয়ে যায়,পরপর দুদিন ? আসলে, প্রচেষ্টা বাঁচাতে মরিয়া সিটি সেন্টারের প্রভাবশালীরা। সেটা এ ডি ডি এ চেয়ারম্যানের সম্ভবত জানা নেই। পুরোদস্তুর শাসক – বিরোধী রাজনৈতিক দলের অন্যতম ঘাঁটি হলেও, প্রচেষ্টায় এসে স্রেফ এক পেয়ালায় বাইরের নকল কুস্তি নিমেষে দোস্তিতে বদলে যায় এখানের কিছু প্রভাবশালীর। বুধবার তাই প্রচেষ্টা বাঁচাতে এডিডিএ’র চেয়ারম্যানের কাছে দরবার করলেন শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। না । তিনি নিজেও জানেন, এতে তার রাজনৈতিক লাভ কিছুটি নেই। আছে তার ঘনিষ্ঠজনদের তোষণ করার গন্ধ আর মুখ্যমন্ত্রীর আদরের নতুন বামুনের গুডবুকে থাকার আলাদা কৌশল। প্রচেষ্টা বাঁচিয়ে ক্লাব ঘরের বন্ধ দরজার ভেতরে উজ্জলের মুখোজ্জ্বল হল বটে, তবে মুখ চুনকালি পড়ল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর সরকারের এডিডিএর। প্রমাণিত হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ও তাহলে ‘তেলা মাথায় তেল’ দেয়। এদিন উজ্জ্বল সাংবাদিকদের বলেন,”আমি বাইরে আছি। ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলবো।” এডিডিএ তে বৈঠক সেরে বেরিয়ে এবার কি তবে লুকিয়ে বাঁচতে চাইছেন উজ্জ্বল ?
বুধবারই অবশ্য এডিডিএর চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় ফের সাফ জানিয়ে দেন,”সে যে কোনও প্রভাবশালীই হোক না কেন, জবরদখল উচ্ছেদে লাল দাগে চিহ্নিত করা সব বেআইনি নির্মাণই ভাঙ্গা হবে। হবেই। ওরকম প্রচেষ্টা ক্লাবকে কারো কোন প্রচেষ্টাতেই ভাঙ্গার হাত থেকে বাঁচানো যাবে না । ভাঙবোই। শুধু সময়ের অপেক্ষা। সময় থাকতে ওরা দামী জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে পারে। ছাড় শুধু এইটুকু।