মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- “লেগে যাওয়া না লাগিয়ে দেওয়া, কোন আগুনের আঁচ বেশি?” পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া এডিডিএ’র তেতলার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলছেন এডিডিএ’রই এসটাবলিশমেন্ট সেকশনের এক কর্মী, আর শুনছেন দুর্গাপুরের দমকল বিভাগের অফিসার সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। অফিসারের হালকা জবাব, “পরিকল্পনা করে লাগানো হলে সে আগুন দাবানলের মতো ছড়াবেই, আর হঠাৎ লেগে যাওয়া আগুন একটু অন্ততঃ সময় দেয়।”
প্রায় ভোর রাত। ঘড়িতে তখন ২:১০টা। রাজ্য দমকল বিভাগের সিটিসেন্টার ফায়ার স্টেশনে আর্জেন্ট কল- ‘এডিডিএ অফিসে আগুন লেগেছে।’ ফায়ার স্টেশন থেকে এডিডিএ সদর দপ্তরের দূরত্ব মেরেকেটে ১১০ মিটার। ভোর রাতের ফাঁকা রাস্তায় সেখানে দমকলের গাড়ির সময় লাগে বড়জোর আড়াই মিনিট। দমকলের অফিসার, কর্মীরা আগুনের লেলিহান শিখা, ঝাঁঝ দেখে হতভম্ভ। ফায়ার অফিসার সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “যে অবস্থায় আমরা এসে দেখলাম, তাতে বোঝাই গেল এই আগুন কম করে দু’ঘণ্টা ধরে জ্বলছে। তাই, ছড়িয়েছে গোটা দপ্তর জুড়ে।”
রাজ্য সরকারের আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এ ডি ডি এ)’র সদর দপ্তর শহরের নগর নিগমের ঠিক উল্টো দিকে। সরকারিভাবে এডিডিএ’র সদ্য নিযুক্ত মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক আকাঙ্ক্ষা ভাস্কর বললেন, “আমরা যা জানতে পারলাম, আগুন ওই সময়েই লেগেছে। তবে, এখনই আমরা অতটা বিশ্লেষণ করিনি। আমরা এর ফরেনসিক তদন্ত করাবো। তাতে, অনেকটা বোঝা যাবে। এ ঘটনার আলাদা করে পূর্ণাঙ্গ তদন্তও দরকার।”
সরকারি পর্যায়ে তদন্তের অপেক্ষা না করে বেলা বাড়ার সাথে সাথেই ঘটনাস্থলে ভিড় জমানো সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরছে একটাই প্রশ্ন- ‘কে এই আগুন লাগালো? এটা পাকা মাথার কাজ। শুধু ফাইল হারিয়ে, লোপাট করেও কাজ না হওয়ায় এবার আস্ত অফিসটাই পুড়িয়ে ছাই করে দিল।’ এদিন যতবারই এই আগুন লাগিয়ে দেওয়া’র তত্ত্ব মাথা ছাড়া দিয়েছে, ভিড় জমানো জনতা, মায় এডিডিএ’র একশ্রেণীর কর্মচারী অস্ফূটে এক ‘অদৃশ্য শক্তি’র প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, “চোখ বন্ধ করলেই তার মুখটাই ভেসে উঠছে বারবার।” কিন্তু তিনি কে? ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ নাকি- যে হঠাৎই গায়েব হয়ে গেলেন? তাকে কি এদিন তবে চোখেই দেখা যায়নি?
আগুন লাগার কথা শোনা মাত্র সটান সিটিসেন্টারের মুখ্য কার্যালয়ে আসানসোল থেকে ছুটে আসেন এডিডিএ’র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্য কার্যনির্বাহী আকাঙ্ক্ষা ভাস্কর, সহকারি কার্যনির্বাহী অভিজিৎ সামন্ত, মানস পান্ডা সহ দপ্তরের সব কর্মী, আধিকারিক ও বাস্তুকার। এডিডি’র ভাইস চেয়ারম্যান কবি দত্ত বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সোমবার সংস্থা কর্মীদের সাথে ‘লাঞ্চ’ করলেও, আগুন লাগার পর মঙ্গলবার তাকে এলাকায় দেখা যায়নি। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি ফোনে জানান তার ‘ব্যক্তিগত’ কাজে তিনি শিলিগুড়িতে রয়েছেন। তবে, আগুন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “খুবই বাজে ব্যাপার হল। ভীষণ বাজে লাগছে।”
“আগুন তো তার মতো দাপিয়ে এডিডিএ’র খাসমহল জুড়ে যাকে বলে ‘লঙ্কা কাণ্ড’বাঁধিয়ে ছেড়েছে। দপ্তরের প্রায় সবকিছুই পুড়ে ছাই। আর কিছুই নাই। আমাদের গোটা অফিসটাই এখন বীরভানপুরের শ্মশানের চুল্লির মতো লাগছে,” বলে আক্ষেপ এক এডিডিএ কর্মীর। শুধু আক্ষেপই নয়, এডিডিএ’র কর্মচারীরা প্রশ্ন তুলছেন,- দপ্তরে অগ্নিনির্বাপনের জন্য লাগানো ফায়ার এক্সটিংগুইশার কেন কাজ করলো না? দমকলের অনুমান মোতাবেক আগুন যদি অন্ততঃ দু’ঘণ্টা আগেও লেগে থাকে, কর্তব্যরত দু’জন নিরাপত্তারক্ষীর সেই আগুন টের পেতে এত বিলম্ব হলো কেন? নিরাপত্তারক্ষীদের একজন জানান, “আমরা রাত দেড়টা’য় আগুন দেখামাত্র ওপর মহলে জানিয়ে দিই।” অর্থাৎ, রাত ১:৩০ টায় খবর পেয়েও তার ৪০ মিনিট পর দমকলে রাত ২:১০টায় জানানো হলো কেন? কিসের অপেক্ষায় এই বিলম্ব?
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে রাজ্য দমকলের বিভাগীয় আধিকারিক এস মজুমদার বলেন, ” এখানে আগুন নেভাতে এসে আমাদের সবচেয়ে বেশি জলের যোগানের সমস্যায় পড়তে হয়। এখানে আশেপাশে কোনো সোর্স নেই। পাশের একটি আবাসন থেকে ইঞ্জিন দিয়ে জল টেনে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়।” এদিন আগুন নেভাতে গিয়ে এক দমকল কর্মী কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
এদিকে, এডিডিএ তে আগুন লাগার পর সেখানে এসে পৌঁছান দুর্গাপুর (পশ্চিম)’র বিধায়ক লক্ষণ ঘোড়ুই। তিনি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করে বলেন, “লাখ লাখ জমি, বাড়ির নথি এভাবে ছাই হয়ে গেল স্রেফ এডিডিএ’র উদাসীনতায়। ব্যাপারটা আমরা অত সহজ ভাবে নিচ্ছি না। দোষীদের খুঁজে বের করতেই হবে।”
বিজেপি নেতার সুরে সুর মিলিয়ে সিপিএমের নেতা সৌরভ দত্ত সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, “এডিডিএ ভস্মীভূত হওয়াটা কি নিছকই দুর্ঘটনা, নাকি আদালতের ভয়ে কোন দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা?”
ঘটনাস্থলে ঠায় সাত ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা এডিডিএ’র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যে বা যারা সমস্ত নথী পুড়ে গেছে বলে স্বস্তি পাচ্ছেন, তাদের জানিয়ে রাখি, প্রায় সমস্ত নথিরই কপি করে অন্যত্র রাখা আছে। আছে নগরোন্নয়ন দপ্তরের হেফাজতেও। সময়ে সবই পাওয়া যাবে।”