মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর: জমি বাড়ির সব নথি বারে বারে কেন পুড়ে ছাই হয়ে যায় ‘আড্ডা’য়?এইসব লেলিহান শিখার আড়ালে মুখ ঢেকে থাকা ধূর্ত কারিগরেরা আসলে নাকি আগুনের আঁচের থেকে অনেক দূরে নিরাপদেই থেকে যায় বরাবর ! তবু প্রশ্ন ওঠে – ‘এডিডিএতে আগুন লাগলে লাভ আসলে ঠিক তাদের হয়?’
না।
অনেক সময় সময়ও নাকি এর সঠিক জবাব দিতে পারেনা। অনেক সময় কপাল চাপড়ে সামনে আসে সেই তারাই যাদের কপাল পোড়ে এই আগুনে। তবে, এমন আগুনে যাদের কপাল খোলে সময়ে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে গিয়ে সুখের সংসারে রাজত্ব করে পা নাচিয়ে। ৩০ বছর পর তাই কি ফের ফিরে আসে আগুন?
সালটা ১৯৯৪ এর এক ভোরবেলা। ভরপুর বাম জমানা। এডিডিএ’র মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক তখন স্বামী সিং। হঠাৎই আগুনে ভস্মিভূত হলো এডিডিএ। বাম আমলে সিটি সেন্টারের বহু মূল্যবান জমি কার কার সুপারিশে, কোনো কোনোটি আবার সুপারিশ ছাড়াই ঢালাও বিলিবন্টন করা হয় এক ফার্নিচারের ব্যবসায়ী, এক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, এক ইলেকট্রনিক দ্রব্যের কারবারী, এক শল্য চিকিৎসক আর এক সরকারি আধিকারিক এর আত্মীয় পরিজনকে। এদের মধ্যে ওই ফার্নিচার ব্যবসায়ীকে নিয়ে দানা বাঁধা বিতর্কর জল বহুদূর গড়ায়। অবাঙালী ওই ব্যবসায়ী ও তার পরিবার স্বামী সিংয়ের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেই নাকি সিটি সেন্টারের কাছাকাছি দুটি বাণিজ্যিক জমি তাদেরকে আয়েশে পাইয়ে দেওয়া হয়। শাসক সিপিএমের বেশিরভাগই নেতা তাতে নাখুশ ছিলেন। স্বামীর সাথে চাপা দ্বন্দ্বও চলেছিল শাসকদলের। এরই মাঝে হঠাৎ সব দ্বন্দ্বে জল ঢেলে দিল উল্কার মতো জেগে ওঠা এক আগুন। পুড়ে ছাই হয়ে গেল ল্যান্ড সেকশন, প্ল্যানিং সেকশনের সব নথি। খাক হয়ে গেল স্বামীর অফিস চেম্বার। ধামাচাপা পড়ে গেল জমি, চাকরির জন্য পাঠানো নেতাদের সব সুপারিশের দস্তাবেজ। তখন এডিডিয়ের ফার্নিচার ছিল সব ভারী, মোটা সেগুন কাঠের। তাই কিছু কিছু সেকশনে আগুন লাগলেও এই বিশ্বকর্মা পুজোর রাতের মতন এতটা বিধ্বংসী হতে পারেনি। “এবারের আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে প্লাই উডের পার্টিশন, ইন্টেরিয়ার ডেকোরেশনের ফলস সিলিং, ফাইবার, কাগজের সাথে থার্মোকলের মিশ্রণের জন্য,” বলে জানালেন বিভাগীয় দমকল আধিকারিক এস মজুমদার। তিনি বললেন, “যেসব জিনিস ব্যবহার করে ইন্টেরিয়ার ডেকোরেশন করা হয়, তার প্রায় সবটাই ভীষণ রকম দাহ্য।” এত দাহ্য বস্তুতে ঠাসা দপ্তর অথচ আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এ ডি ডি এ)র সদর দপ্তরের অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থাটা এতটাই নড়বড়ে, যে সব পুড়ে খাক হয়ে গেল, আর বাজলোইনা কোন ফায়ার অ্যালার্ম? কেন?
আসলে, ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে সুমিত গুপ্ত মুখ্য কার্যনির্বাহী থাকার সময় এ ডি ডি এ সদর দপ্তরের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ঢালাও খরচ করে বদল করা হয়। খরচ হয় ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। পরে, অরুণ প্রসাদের সময় কিছু কাজ হলেও টাকার অংকটা কমছিল। আর তা ছিল মূলত বাহ্যিক কিছু অদল বদল। দুর্গাপুর দমকল বিভাগের এক কর্তা জানান, “১৯৭৬ সালের এই বিল্ডিং এ সম্প্রতি ঢালাও ইন্টেরিয়ার এর কাজ করা হল ন বছর আগে। তখনই আমরা অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার করুন দশা নিয়ে সরকারিভাবে চিঠি দিয়ে জানাই। আজকের অগ্নিকাণ্ডের পর বোঝা গেল এনারা ওসব পরামর্শ কানেই তোলেননি।” প্রশ্ন – আগে ১৯৯৪ এর আগুনে বহু নথি, তথ্য ছাই হয়ে যাওয়ার পরও বিশেষত দমকল বিভাগ সচেতন করার পরও অগ্নি নির্বাপন নিয়ে এতটা নিস্পৃহ কেন থাকলো এ ডি ডি এ? এডিডি এর চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দমকল বিভাগ ঠিক কি কি পরামর্শ দিয়েছিল তা ভালো করে খোঁজ নিতে হবে। কেনই বা তা মানা হয়নি তাও দেখা দরকার। পরিস্থিতি সামলে নিয়ে সবদিক খতিয়ে দেখা হবে।”
এদিনের আগুনে এ ডি ডি এ’ র সদর দপ্তরের ত্রিতলের সম্পূর্ণ নয় হাজার বর্গফুট অফিস চত্বরটাই ভস্মিভূত হয়ে যায়। বিকাল ৫ টা পর্যন্ত ১.১৫ লক্ষ লিটার জল ঢেলেও আঁচ কমাতে পারেনি দমকল। রাত্রি ১০:৪৫ নাগাদ নতুন করে জল চার্জ করা শুরু হয়। তখনই ত্রিতল থেকে এদিনের মতো নেমে আসেন এ ডি ডি এ’র বস্তুকার, কর্মীরা। আগুনের খবর পেয়ে কাকভোরে আসানসোল থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে ছুটে আসেন চেয়ারম্যান তাপস এবং শহরেই বসবাসকারী কর্মী, আধিকারিকরা। মঙ্গলবার দিনভর কার্যত অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে তারা দেখলেন ওই লঙ্কাকাণ্ড কি নিষ্ঠুর ভাবে ছাই করে দিলো পুরো দপ্তরটাকেই। এই আগুনের মাঝেই কর্মী, আধিকারিকদের নিয়ে একদফা বৈঠক করেন মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক আকাঙ্ক্ষা ভাস্কর। ঠিক হয়, আপাতত ভবনের দ্বিতলে বুধবার থেকে অস্থায়ী অফিস চলবে। বুধবার বেলা ১১:০০ টায় ঢুকবে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের একটি তদন্তকারী দল। আকাঙ্ক্ষা ভাস্কর অবশ্য জোর দিয়ে বলেন, “বিজয় দশমীর মধ্যেই এই অফিস নতুন করে সাজিয়ে ফের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।”