adddবিশেষ প্রতিনিধি, দুর্গাপুরঃ কৈ মিল গয়া! কাকে পাওয়া গেল? তাকে-ই, যাকে টানা পঁচিশ বছর চোখেই দেখেননি এলাকার কেউ। কিন্তু, খুঁজেই বা কে পেল?- অ-তনু। মানে যার তনু অর্থাৎ শরীর নেই, তিনিই আচমকা আবিষ্কার করলেন বেমালুম নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধ শরীর। তাও আবার দু’শো কিলোমিটার দূরে, শহর কলকাতার লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে। কেয়া বাৎ! কেয়া বাৎ!! অভিধানে বলা আছে অতনু শব্দের অর্থ আবার ‘ভাগ্যবান’।
“অতনু ভাগ্যবানই বটে। না হলে পঁচিশ বছর আগে বেমালুম গায়েব হয়ে যাওয়া একটা মানুষকে, যাকে তার চল্লিশ বছরের বন্ধুও হাজার চেষ্টা করেও খুঁজে পেল না, আর লোকটার বাড়ীতে ‘জুড়ে বসে’ কয়েক মাসেই অতনু পেয়ে গেল সুকেশ চন্দ্র বসুর খোঁজ?”- বেশ সন্দেহের চাউনিতে চোখ তুলে বিস্ময় অতনুর এক সহকর্মীর। বেশ স্বগতোক্তির সাথেই বললেন, “এখানে দেখছি সবই হবে এবার।”
‘অমানুষ’ ছবিতে উত্তম কুমারের লিপে একটি গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল-“মরা মানুষ বাঁচিয়ে তোলে, এমনি যে তার যাদু-,বিপিন বাবুর কারণ সুধা, মেটায় জ্বালা, মেটায় ক্ষুধা!!”
জ্বালা-ক্ষুধা আর ক্ষুধার জ্বালা কিন্তু এক জিনিস নয়। জ্বালাতে মানুষ উদ্ভ্রান্ত হয়ে যায়, ক্ষুধায় হয় দিশেহারা আর ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ করে ছটফট। অন্তত অতনুর দশা দেখে তার কর্মস্থল আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (এডিডিএ)-তে তার সহকর্মী, উর্ধতন কর্তাদের গত কয়েকমাস তাই-ই মনে হচ্ছিল। ওদেরই একাংশ, যারা পাত পেড়ে আলাউদ্দিন খান বিথিতে অতনুর নতুন ডেরায় ভূরিভোজ করে গেছিলেন গত মার্চ মাসে, তারা বেশ বড় গলায় বলছেন, “অতনু তো খুঁজে পেয়েছে সুকেশবাবুকে। আর কোনো টেনশন নাই। সামনের হপ্তায় তো ওই বাড়ির রেজিস্ট্রিটাও সেরে ফেলবে অতনু। সেরকমই পাকা বন্দোবস্ত করেছেন আমাদের দুজন সাহেব।”
বন্দোবস্ত তো নিজের লোকের জন্য আগবাড়িয়ে সব বাড়ীতেই করা হয়। তা বলে সরকারি দপ্তরেও? বিশেষতঃ যে বন্দোবস্তের দরুন রাজ্য সরকারের ওই সংস্থা এডিডিএ অন্ততঃ চল্লিশ লক্ষ টাকার রাজস্ব হারালো? “এরকম নাকের ডগায় স্বজনপোষণ এডিডিএ-তে আমরা আগে দেখিনি,” দাবি সংস্থার কর্মীদের একাংশের। তাদের কথায়, “কারো বাড়ীতে লুঠ হয়, তবে আস্ত বাড়ীটাই ‘লুঠ’ হয়ে যাবে দিনে দুপুরে, এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে কি?”
এডিডিএ-র এক কর্মচারী সিটিসেন্টারে একটি ঘর কিনছেন, তাতে এত শোরগোল, বিতর্কের আছেটা কি?
সরকারি চাকরিতে থাকা যেকোনো কর্মী, আধিকারিক পরিবারের বসবাসের জন্য একটি ঘর বানাতেই পারেন বা কিনে নিতেই পারেন। তা নিয়ে এত প্রশ্ন ওঠার কথাও নয়, যদি সেটা সোজাসাপটা খরিদ্দারি হয়ে থাকে। প্রশ্ন-আড্ডার কর্মী অতনু চক্রবর্তী সিটিসেন্টারের আলাউদ্দিন খান বিথির যে বাড়ীতে বসবাস করছেন সেটি কি তবে সোজাপথে খরিদ করা নয়?
এককথায় জবাব-না। সোজাপথে নয়। অ-নেক, অ-নেক ঘুরপথে ওটি এখন অতনুর কব্জায়।
সুকেশ চন্দ্র বসু ১৯৮৮ সালে, সি/১০, আলাউদ্দিন খান বিথির ৩ কাঠা পরিমাপের জমিটি এডিডিএ-র কাছ থেকে ৯৯৯ বছরের জন্য লীজ ডিড পান। কিন্তু, ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে, এডিডিএ-র আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে, সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে সুকেশ ওই জমিটিকে এক অজিত কুমার চ্যাটার্জী ও তার স্ত্রী অনিতা চ্যাটার্জীকে হস্তান্তর করেন ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নী’ বলে। ব্যাস, তারপরেই যাকে বলে কর্পূরের মতো উবে যান সুকেশ। অজিত ও তার স্ত্রী সুকেশের বাড়ীতে বিনা ভাড়ায়, কার্যত নিখরচায় থেকে গেলেন টানা ২৬ বছর। বাড়ির ফটকে বসিয়ে ফেললেন শ্বেতপাথরের নেমপ্লেট-নিজের, স্ত্রী আর পুত্রের নামে।
আরো মজার বিষয়, অজিত-অনিতার পুত্রের নামও অতনু।
অতনু চ্যাটার্জি-কি সমাপতন! একে-একে দুই।
ছাব্বিশ বছর ধরে লোকের বাড়ীকে নিজের বাড়ী বলে চালানো অজিত কিন্তু দুর্গাপুর নগর-নিগমে ঐ বাড়ীর হোল্ডিং ট্যাক্স জমা করে যাচ্ছেন সুকেশের নামেই। কারণ, আইনতঃ সুকেশের অনুপস্থিতিতে নিছক একটি ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নী’ বলে তা বদলানো সম্ভব নয় বলেই। নাম বদলাতে পারেন নি অজিত পুত্র অতনুও। আর আইন-কানুন, রীতি-নীতি সব উপড়ে ফেলে ঘরটিতে জুড়ে বসলেন নতুন অতনু। অজিতের কথায়, “অনেক খুঁজেছি সুকেশবাবুকে। আমার বন্ধু ছিলেন। কিন্তু তার খোঁজ মেলেনি। তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
অজিত এমন বন্ধু যাকে জমি বাড়ী সঁপে দিয়ে বেবাক বেপাত্তা হয়ে গেলেন সুকেশ। ছাব্বিশ বছর তাকে খুঁজে পেলেন না বন্ধু অজিত। আর ছাব্বিশ মাস গড়াতেই খড়ের গাদায় সূচের মতো সেই “খুড়ো”কেই খুঁজে ফেললেন এই অতনু। “বাহাদুরি আছে অতনু স্যারের। মানতে হবে,” বললেন আড্ডায় ঘুর ঘুর করা ভিড়িঙ্গী থেকে আসা এক জমির দালাল। (চলবে)