eaibanglai
Homeএই বাংলায়বালি মাফিয়া সিন্ডিকেটের দৌলতে জলে ডুবে প্রাণ গেল জেসিবি খালাসীর

বালি মাফিয়া সিন্ডিকেটের দৌলতে জলে ডুবে প্রাণ গেল জেসিবি খালাসীর

নির্দেশিকায় সার, অবাধে চলছে মেশিন দিয়ে বালি উত্তেলন , দামোদরে বালিখাদে তলিয়ে গেল খোদ বালিঘাটেরই জেসিবি’র খালাসী।

সংবাদদাতা, দুর্গাপুর:- হাইকোর্টের নির্দেশিকায় সার। বাজেয়াপ্ত করা দুর অস্ত। উল্টে রমরমিয়ে চলছে মেশিন দিয়ে বালি উত্তোলন। আর ওই বালিখাদে স্নান করতে নেমে তলিয়ে গেল খোদ বালিঘাটেরই জেসিবি র খালাসী। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে দামোদর নদের ওপর বড়জোড়া পখন্না বালিখাদে। নজরদারি শিকেয়। প্রশ্ন উঠেছে ভুমি রাজস্ব দফতর ও পুলিশের ভুমিকায়।

পুলিশের একটি সুত্রে থেকে জানা গেছে, মৃত জেসিবি খালাসীর নাম সেখ মাহির হোসেন (১৯)। গলসীর জাগুলিপাড়ার বাসিন্দা। গত প্রায় দেড় বছর ধরে পখন্ন বালিঘাটে জেসিবি খালসীর কাজ করছে বলে পরিবার সুত্রে জানা গেছে। ঘটনায় জানা গেছে, গত বুধবার বিকালে কাজ শেষে স্নান করতে নেমেছিল মেশিন দিয়ে বালি তোলার কাজে নিযুক্ত জেসিবি খালাসী সেখ মাহির হোসেন (১৯) বালিখাদের জলে। ওইসময় পা ফঁসকে তলিয়ে যায়। আশপাশের বালিঘাটের লোকজন খোঁজাখুজি শুরু করলেও সেই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কেন হদিশ পাওয়া যায়নি। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বড়জোড়া থানার পুলিশ। পরদিন অর্থাৎ বৃহঃস্পতিবার সকাল থেকে বিপর্যয় মোকাবিল দল স্পিড বোট নিয়ে তল্লাশী শুরু করে। দুপুর পর্যন্ত কোন হদিশ না পাওয়ায় আসানসোল থেকে কেন্দ্রীয় বিপর্যয় মোকাবিলার দল আনা হয়। বিকাল নাগাদ ওই যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ঘটনার পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে এলাকাবাসী। মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপিরণের দাবীতে বিক্ষোভ শুরু করে। ফলে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ, অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের জেরে বিপন্ন জনজীবন। সেচের জলের টান পড়ছে কৃষিজমিতে।

উল্লেখ্য, দামোদর নদে ড্রেজিংয়ের নামে বালি তোলার অনুমতি পায় এক বেসরকারী সংস্থা। আর ওই ড্রেজিংয়ের নামে নিম্ন দামোদরের পলাশডাঙা ও গোপালপুর মৌজায় ওই সংস্থার কমবেশী ২০ টি পাম্প ও ৮টি ছাঁকনি মেশিন দিয়ে বালি তোলার কাজ চলছিল বলে অভিযোগ। পাম্প বসিয়ে কিম্বা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বালি উত্তোলনে গ্রীনট্রাইবুনালের কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। গ্রীন ট্রাইবুনালের নির্দেশিকাকে উপেক্ষা করে মেশিন বসিয়ে অবাধে চলে বালি উত্তোলন দিন রাত। নদীতে নাকি পাম্প বসিয়ে জলমিশ্রিত বালি তোলা হয়। জলবালি মিশ্রিত বিশেষ ছাকনির সাহায্যে বালি আলাদা করা হয় নদীতে। তারপর ওই বালি জেসিবি মেশিন দিয়ে লরিতে ভর্তি হয়ে চলে যায় শহরে। আর পাম্প বসিয়ে বালি তোলার ফলে নদীতে গভীর খাদ তৈরী হয়। আর এই খাদ তৈরী হওয়ায় আশপাশের কৃষিজমি এলাকায় ভুগর্ভস্ত জলের টান পড়ছে। ফলে কৃষিকাজের সাবমার্শিবাল ও সেলো পাম্পে জল উঠছে না। তেমনই স্নান করতে নেমে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

দামেদর নদের উত্তর প্রান্তে পানাগড়- দুর্গাপুর সংলগ্ন মানাচর। ভৌগলিক মানচিত্রে বাঁকুড়ার বড়জোড়া ও সোনামুখী ব্লকের অন্তর্গত। বড়জোড়া ব্লকের ঘুটগড়িয়া পঞ্চায়েতের সিতারামপুর, বড়জোড়া পঞ্চায়েতের রামকৃষ্ণপল্লী, বরিশাল পাড়া, পল্লীশ্রী কলোনী, পখন্না পঞ্চায়েতের বড় মানা, পশ্চিম পাড়া, ঢাকা পাড়া, ভৈরবপুর, ভৈরবপুর মানা, সোনামুখী ব্লকের রাঙামাটি পঞ্চায়েতের ডিহিপাড়া উত্তর মানাচর, লালবাবা মানাচর। সব মিলিয়ে ১১ টি গ্রাম সাংসদ রয়েছে। প্রায় ১২ হাজার ভোটার সংখ্যা। সবই পুর্ব বঙ্গ থেকে আগত বাসিন্দা। প্রায় ৫০- ৬০ বছর ধরে নদীর বুকে বসবাস করছে। নদী তিরবর্তী গ্রামবাসীদের কৃষির ওপর নির্ভরশীল জীবিকা। নদীর চরকে উর্বর করে চাষাবাদ করে তুলেছে। আলু, পটল, পেয়াজ, নানান শাক সব্জি ছাড়াও বাদাম চাষ হয়। প্রায় ৩০০ একর কৃষি জমি রয়েছে। সম্প্রতি প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে। চাষীদের অভিযোগ,” নদীতে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের ফলে চাষজমি এলাকায় জলস্তর হু হু করে নেমে গেছে। ফলে বাদাম চাষে সেচের জলের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ধার দেনা করে বাদাম চাষ করে এখন জলের টানে চোখে সরষেফুল দেখছি। গোটা এলাকায় জলসঙ্কটে ভুগছে। এককথায় নদী তিরবর্তী জনজীবন বিপন্ন। বালি বোঝাই বেপরিয়া লরি, ডাম্পার, ট্রাক্টর যাতায়াতে ভাঙছে গ্রামের রাস্তা। দুর্ঘটনার শঙ্কায় গ্রামবাসীরা।” স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন,” বহুবার পুলিশ ও প্রশাসনকে জানিয়েছি। কোন কাজ হয়নি। উল্টে পুলিশ মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রামবাসীদের গ্রেফতার করছে। গত কয়েকমাস ধরে বড়জোড়ার পল্লীশ্রী, চকবাজার, বরিশাল মানাচরে বালিবোঝাই লরি ডাম্পার যাতায়াতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছে এলাকাবাসী।

স্থানীয় সূত্র মারফত জানা গেছে এলাকার বাসিন্দাদেরকে রীতিমতো ভয় দেখিয়ে দিন রাত সমানে জেসিবি মেশিন দিয়ে বালি লুঠ চালিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের লোকজনেরা। এও জানা যায় বালি মাফিয়া সিন্ডিকেটের আরো বেশ কয়েকটি ঘাট রয়েছে পশ্চিম বর্ধমান জেলা ও বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে। সেখানেও একই পদ্ধতিতে দেদার চলছে বালি লুঠের কারবার। পুলিশের একটি সূত্র মারফত জানা গেছে, বালি মাফিয়া সিন্ডিকেট শুধু বালি লুঠেই নয়, জমির লুঠেও নাম রয়েছে। কাঁকসা এলাকায় একটি পুকুর ভরাট করে তাতে হাসপাতাল বানানোর কাজ চলছে জোর কদমে। স্থানীয় প্রশাসনের একাংশের প্রত্যক্ষ মদতে চলছে জমি ও বালি লুঠের কারবার বলে অভিযোগ।

সুত্র মারফত এও জানা গেছে, মহাভারতের ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এর সাথে হাত মিলিয়ে নাকি বালি মাফিয়া সিন্ডিকেটের সাঙ্গ পাঙ্গরা পাণ্ডবেশ্বরের অজয় নদের বুকে আরও বেশ কয়েকটি ঘাট অবৈধভাবে চালাচ্ছে । প্রতিদিন কয়েকশো ডাম্পার ও লরি বিনা চালানে ও ওভার লোড হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে রাজ্য তথা ভিন রাজ্যে। সংবাদকর্মীরা ইতিমধ্যেই বালি মাফিয়া সিন্ডিকেটের সমস্ত লোকজনের নাম যোগাড় করে ফেলেছে বলেও জানা গেছে। এবার তাদের বিরুদ্ধে আরো তথ্য ও অভিযোগ জোগাড় করার কাজ চলছে জোর কদমে। কিন্তু ভাবতেও অবাক লাগে সম্বলহীন, অসহায় সাংবাদিকরা যদি বালি মাফিয়া সিন্ডিকেটের তথ্য জোগাড় করতে পারছে, তাহলে জেলা প্রশাসনের উচ্চ আধিকারিকরা কেন তার কোনো তথ্য পাচ্ছেন না? নাকি তাদের সঙ্গেও বন্দোবস্ত করে রেখেছে এই বালি মাফিয়া সিন্ডিকেটের লোকজনেরা।

পুলিশের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে হাইকের্টের দারস্ত হয় স্থানীয় চাষীরা। বালি কারবারিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন চকবাজার মানাচরে কৃষক শ্যামল মন্ডল। মাসখানেক আগে ওই মামলায় শুনানিতে হাইকোর্টের চিপ জাস্টিক টিএস শিবগান্নাম ও জাস্টিক হিরন্ময় ভট্টাচার্য মামলার রায় দিয়েছেন। নির্দেশনামা W.P.A.(P)-163/2024, তাতে আগামী ৮ সপ্তাহের মধ্যে বড়জোড়া এলাকায় দামোদরে অবৈধ উত্তোলনে জেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ওইসব ঘাট এলাকায় যাবতীয় যন্ত্রপাতি, মেশিন ও পরিবহন গাড়ী বাজেয়াপ্ত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু নির্দেশিকায় সার। তারপরও রমিরমিয়ে চলছিল মেশিন দিয়ে বালি উত্তোলন।

উল্লেখ্য, গত ২০২৩ সালের ৭ জুলাই সোনামুখী থানার দামোদর রাঙামাটি ঘাটে স্নান করতে নেমে আদিত্য চ্যাটার্জী (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। তার কয়েকদিন পর ২১ জুলাই বড়জোড়ার পখন্না মানাচরে দামোদর পারাপার করতে গিয়ে তলয়ে মৃত্যু হয় এক অজ্ঞাত পরিচয় যুবকের।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments