মনোজ সিংহ, কল্যাণী: বাংলাদেশে অচলাবস্থার ধাক্কায় এবার কি রাজ্য সরকারের শিল্প তালুকে উদ্বাস্তু চাষ শুরু হলো এ রাজ্যে? কাঠার পর কাঠা শিল্পের জন্য বরাদ্দ জমি ভিন দেশি উদ্বাস্তুদেরকে ঢালাও বিক্রি করার ঘটনা জানার পরও সরকারি সংস্থার উদাসীন নীরবতার ঘটনায় আরো স্পষ্ট হচ্ছে যে – মুখ্যমন্ত্রী যতই শিল্পের প্রত্যাশী হন না কেন, তার দল এবং সরকারি শিল্প পরিকাঠামো সংস্থাগুলির প্রশ্রয় তলে তলে কোটি কোটি টাকায় দেদার শিল্পের জমি বেচে দিয়ে কিছু আমলা সেই স্বপ্নে জল ঢালতে উঠে পড়ে লেগেছে।

রাজ্য সরকারের সাধের কল্যানী শিল্প তালুকে গত কয়েক মাসে পুলিশ প্রশাসন এবং রাজ্য সরকারের শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত আমলাদের চোখের সামনে রীতিমত প্লট করে, দর হেঁকে শিল্পের জমিতে বাংলাদেশী উদ্বাস্তু, শরণার্থীদের জামাই আদরে বসাচ্ছেন। তা হচ্ছে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস আর বিরোধী বিজেপির স্থানীয় স্তরের একশ্রেণীর হাফ নেতা, নাটা নেতার প্রত্যক্ষ মদতে। আবার সব জেনে বঝেও নাক গলাতে ইতস্তত করছে খোদ সরকারি দপ্তর ও পুলিশ।
অথচ এই নিয়ে জেলা শাসকের দপ্তর, পুলিশ তো বটেই শিল্পের ওই জমিগুলির মালিক খোদ রাজ্য শিল্প পুনর্গঠন দপ্তরের কলকাতা সদর দপ্তরেও তথ্য প্রমাণ সহ অভিযোগ লিপি জমা দিয়েছেন শিল্প তালুকের কয়েকজন উদ্যোগপতি এবং অন্তত চার ডজন স্থায়ীয় বাসিন্দা। কল্যাণী শিল্পতালুক লাগোওয়া দক্ষিণ চাঁদমারি গ্রামের বিক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের ক্ষোভ , “আমাদের চাষের জমি এখানে যাতে শিল্প গড়ে ওঠে তার জন্য দিয়েছিলাম। অথচ এখন ফড়েদের মাধ্যমে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে খদ্দের ধরে এনে এইসব জমি অনায়াসে, বিনা বাধায় বেচে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে এবার কি তবে গড়া হবে উদ্বাস্তু কলোনী? এ কেমন কথা? এসব কি মেনে নেওয়া যায়?” তাদের মতে,”রাজ্য সরকারের যখন শিল্প করার মুরোদ নেই, তখন আমাদের জমি ফিরিয়ে দিক। এই জমিতে এইভাবে উদ্বাস্তু চাষ আমরা মানবো কেন?”
বিষয়টিতে বিরক্ত, আতঙ্কিত, দক্ষিণ চাঁদ মারির বাসিন্দারা একটি ‘শান্তি রক্ষা কমিটি’ গঠন করে আগামী দিনে ‘চিরকালীন অশান্তি’ রুখতে চাইছেন। বিক্ষুব্ধ বাসিন্দা সুধাংশু মন্ডল, অরবিন্দ রায়, সুনীল সরকার, দিলু বাড়ুই, রেখা ঘরামিদের মিলিত অভিযোগ, “সরকারের দপ্তর সব দেখে শুনে কেনইবা হাত গুটিয়ে বসে আছে বুঝতে পারছিনা। আর সেই সুযোগে এখানে সক্রিয় জমির দালালেরা জাল নথি তৈরি করে রীতিমত প্লটিং করে দিনে দুপুরে শিল্পের জমিতে আরেকটা বাংলাদেশে বসাচ্ছে। এইসব অবৈধ কাজ বন্ধ করার জন্যই আমরা ‘শান্তিরক্ষা কমিটি’ তৈরি করেছি। এইসব লুঠ আমরা কিছুতেই মানবো না।”
প্রতিবাদ লিপিতে স্থানীয় বাসিন্দারা স্পষ্টভাবে কয়েকজন জমির দালালের নাম ঠিকানাও উল্লেখ করে পুলিশ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানিয়ে দিয়েছেন।। তাদের দাগিয়ে দেওয়া দালালেরা এরকম – রতন ঘরামি, কার্তিক ঘরামি, সখানাথ বারুই। অভিযুক্ত দালালেরা সকলেই কল্যাণীর রবীন্দ্রনাথ কলোনী এবং দক্ষিণ চাঁদমারি পাড়ার বাসিন্দা। বাসিন্দাদের অভিযোগ, এদের জমি লুঠের প্রতিবাদ করায় এরা স্থানীয় মানুষজনকে ক্রমাগত ভীত সন্ত্রন্ত করে চলেছে। থানায় অভিযোগ করতে গেলেও পুলিশ অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ধমকাচ্ছে”।
গত সপ্তাহে হতাশ বাসিন্দারা কলকাতায় রাজ্য শিল্প পুনর্গঠন দপ্তরের মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক ময়ূরী বাসুর কাছেও আলাদা করে এই বিষয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। “উনি এলেন কল্যাণী শিল্প তালুকের ১ নম্বর আর ৩ নম্বর ফেজে কিন্তু আসল জবরদখল করে উদ্বাস্তু চাষের ওই ২ নম্বর ফেজে গেলেনইনা। আর তিনি ফিরে যেতেই দেখছি এখানকার দালালেরা আরও সক্রিয় হয়ে ডোজার, ডাম্পার, লাগিয়ে জমি ভরাট, প্লটিংয়ের কাজ আরো জোর কদমে শুরু করে দিল। এ কেমন পরিদর্শন করলেন উনি?” – প্রশ্ন ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের।
শুধু শিল্প দপ্তরেই নয়, শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন দপ্তরে গা-ছাড়া, গড়িমসি ভাব দেখে বিরক্ত বাসিন্দারা বিষয়টিতে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে শনিবারে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। কল্যাণীতে শিল্পের জমি লুট নিয়ে হতাশ বিনিয়োগকারীরাও রাজ্যের দ্রুত হস্তক্ষেপ চাইছেন এখানকার ফেজ- ২ র এক বিনিয়োগকারী অমল রায় বলেন, “গোটা বিষয়টি যথাযত জায়গায় জানিয়েছি। তবে, কয়েকদিন কেটে গেলেও ওনারা কিছুই করেননি এখনো। উল্টে এদিকে হুমকি, শাসানি বেড়েছে। বেড়েছে জমি দখলের উৎপাতও।” এদিকে, নদীয়ার জেলাশাসক অরুণ প্রসাদ শনিবারে বিষয়টিতে অবগত হয়ে বলেন, “ওদের অভিযোগ পেলাম। আমরা দ্রুত এই নিয়ে হস্তক্ষেপ করছি। শিল্পের জমিতে এমন দখলদারি মানা হবে না।”





