সংবাদদাতা,বাঁকুড়াঃ- ভাদু পুজোতে মাতলো জঙ্গল মহল। ভাদু মুলত রাঢ় বাংলার উৎসব। পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর এমনকি লাগোয়া, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-এক জেলায় লোক উৎসব হিসাবে ভাদ্র সংক্রান্তিতে মহা সমারোহে উদযাপিত হয় ভাদু উৎসব।
তবে বর্তমান দ্রুত গতির জীবনে রাঢ় বাংলার অনেক লোক সংস্কৃতি, লোক উৎসব হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই ভাদু উৎসবকে ধরে রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে বাঁকুড়ার সারেঙ্গা ব্লকের ছোট সারেঙ্গা ইচ্ছে ডানা ক্লাব। রীতিমতো ফিতে কেটে উদ্বোধন হল তাদের ভাদু পুজোর। উদ্বোধন করেন সারেঙ্গা থানার আই সি সুজিত কুমার ভট্টাচার্য্য। শুধু উদ্বোধন নয়, পুজোয় অন্য মাত্রা আনতে মহিলারা মঙ্গল ঘট নিয়ে শোভা যাত্রা করেন। শোভাযাত্রা শেষে লোক রীতিমতো ভাদুর সামনে প্রসাদের ডালি সাজিয়ে হয় পুজো ও ভাদুর গান। ভাদুর গানের মধ্যে ফুটে ওঠে ইতিহাস,পুরান থেকে রামায়ণ মহাভারত ও বর্তমান সমাজ জীবনের ভিবিন্ন বিষয়। এছাড়া সাধারণ গৃহস্থ ও গৃহিনীদের জীবন কাহিনী, সুখ, দুঃখ ও বেদনা এই গানগুলির মূল উপজীব্য। ভাদু গান বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গাওয়ার রীতি আছে। আসলে ভাদু মুলত গান-কেন্দ্রিক লোক-উৎসব। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে ভাদু পুজো হলেও মহিলারা ভাদু ব্রত শুরু করেন ভাদ্র মাসের শুরুতে। এক মাস ধরে চলে ব্রত।
কিন্তু কে এই ভাদু। যাকে রাঢ় বাংলার মহিলারা ভক্তি ভরে পুজো করেন। এ নিয়ে নানা কাহিনি, গল্প প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলেন, ভাদু আসলে লক্ষ্মী। দেবী লক্ষ্মী যেহেতু বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন নামে পূজিতা হন তাই ভাদ্র মাসের পূজিতা লক্ষ্মীই ভাদু। কারণ এই মসয় মাঠের ধান ঘরে ওঠে। তাই ফসল তুলে ধনলক্ষ্মীর আরাধনাই ক্রমে ভাদু পুজোর রূপ নেয়।
অন্য মতও রয়েছে। যার সঙ্গে বাস্তবের কাহিনি জড়িয়ে আছে। অনেকে মনে করেণ ভাদু আসলে পুরুলিয়ার এক রাজা নীলমণি সিংহদেওয়ের কন্যা ভদ্রাবতীর সংক্ষিপ্ত নাম। তিনি অন্ত্যজ শ্রেণির এক জনকে ভালবাসতেন। কিন্তু পিতা মেনে নিতে পারেননি সেই সম্পর্ক। তাই ভাদু আত্মহত্যা করেন। রাজা মেয়ের স্মৃতিতে শুরু করেন ভাদু পুজো। কেউ কেউ বলেন প্রেম নয়, ব্যাধির কারণে মৃত্যু হয় ভাদুর । রাজা মেয়েকে হারিয়ে তাঁর নামে চালু করেন স্মৃতি-তর্পণ। অন্য আর এক মতে ভাদু আসলে পুরুলিয়ার কাশীপুরের রাজার মেয়ে। বিয়ে ঠিক হয়েছিল বর্ধমানের রাজকুমারের সঙ্গে। বিয়ের দিন বিয়ে করতে যাওয়ার পথে ডাকাতদের হামলায় মৃত্যু হয় তার। রাজকুমারের মৃত্যু সংবাদ সহ্য করতে না পেরে বিয়ের দিনই আত্মঘাতী হন রাজকন্যা ভাদু। সেই রাজকন্যা ভাদুর স্মৃতিতেই কাশীপুরের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয় ভাদু উৎসব। আবার অনেকে ভাদুর সঙ্গে মীরাবাই-এর মিল পান। যেখানে রাজকন্যা ভাদু, জন্ম থেকেই মীরার মতো কৃষ্ণভক্ত। রাজা তাঁর বিবাহ ঠিক করলে ভাদু মন্দিরে ধ্যানস্থ অবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করেন। কেউ কেউ ভাদুকে বাঁকুড়ার মল্ল রাজাদের কন্যা ভদ্রাবতী বলে মনে করেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে ভাদু পুজোর প্রচলন হয়। আবার কেউ বলেন, ভাদ্রমাসে পঞ্চকোট ও ছাতনার রাজার মধ্যে যুদ্ধে পঞ্চকোটের রাজা বিজয়ী হন। সেই স্মৃতিতেই এই গান ও উৎসবের সূত্রপাত।
গবেষকদের গবেষণা যাই বলুক, ভাদ্র মাসের শেষ দিনটিতে প্রাচীন এই লোক-উৎসবের জন্য এখনও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন রাঢ় বাংলার বহু মানুষ। গানের পাশাপাশি ভাদু উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ থাকে খাওয়া-দাওয়া। কারণ ভাদুকে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন মিষ্টান্ন তৈরির প্রথা। যার মধ্যে প্রধান মিষ্টি জিলিপি। ভাদুর মিষ্টির সেই জৌলুস এখন না থাকলেও ঐতিহ্য রয়েই গিয়েছে।