মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর:- ঠিক ১২ বছর পর ভাড়া করে আনা বাইজিরা ফের কোমর দোলাতে শুরু করেছে শহরের ঝাঁচকচকে শপিংমলগুলিতে। উড়ছে দেদার টাকা, ছুটছে মদের ফোয়ারা। অশ্লীল বাইজি পাড়াগুলি নিয়ে যদিও বিরক্ত যেমন এখানকার নগর নিগম, তেমনি জেলা প্রশাসন এবং শাসক দল। তা সত্বেও কেবল একটা ঠুনকো বার লাইসেন্স হাতিয়ার করে সবার চোখের সামনেই মাঝরাত অবধি দেদার চলছে অশ্লীল উন্মুক্ত যৌনতার এই লীলাখেলা।
শিল্পশহর দুর্গাপুরের বেনাচিতি ও সিটি সেন্টার এর দুটি শপিংমলে বিগত কিছুদিন ধরেই নিয়ম করে বসছে বাইজিদের আসর। সেখানে চলছে দেদার নাচগান মদ মচ্ছবের দেদার ফুর্তি। এর দরুন ওই দুই মলের দুটি পানশালায় সম্প্রতি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও দেখা যাচ্ছে কিছু ধনী ব্যবসায়ীর ছেলেদের সাথে। কিছু অভিযোগ পাওয়ার পর সম্প্রতি শহরের সেপকো টাউনশিপের একটি বাড়িতে হানা দেয় দুর্গাপুর পুলিশের একটি দল। সিটি সেন্টার সংলগ্ন সেপকোর বাসিন্দা প্রাক্তন এক ইস্পাত কর্মীর বাড়িটি ভাড়া নিয়ে শপিংমল গুলিতে টাকার জন্য নাচতে যাওয়া বাইজিদের রাখা হচ্ছিল বলে অভিযোগ। রাতবিরাতে ওই ভাড়া বাড়িতে নাকি দামি দামি গাড়ি চড়ে বহিরাগতদের আনাগোনা বাড়তে থাকায় প্রতিবেশীদের সন্দেহ বাড়তে থাকে।
এরই মাঝে গত ১৫ মে স্থানীয় বাসিন্দারা ওই বাড়িটিকে ঘিরে বিক্ষোভে ভেঙে পড়েন। তাদের দাবি অন্তত ত্রিশ জন বাইরে থেকে আসা মহিলা নিয়মিত থাকছিল ওই বাড়িতে। ওই বাড়িটির লাগোয়া একটি বাড়ির বাসিন্দা সীমা সিংহ শেষে অতিষ্ঠ হয়ে দুর্গাপুর মহকুমা শাসকের দপ্তরে অভিযোগ জানানোর পর ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। পুলিশের সামনেই সীমা সহ অন্যান্য মুখর প্রতিবেশীরা দাবি করেন ওই বাড়িটিতে নারী দেহের ব্যবসার ডেরা বানাতে চাইছে বহিরাগত কিছু লোকজন। তারা ২৪ ঘন্টার প্রহরী রাখার পাশাপাশি ঘরটিতে থাকা মহিলাদের বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার নামে পুষে রেখেছে কিছু বাউন্সার। বলশালী বাউনসারদের দাপটে ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। সীমা বলেন, “রাতবিরাতে গাড়ি আসছে। লোক ঢুকছে ওই ঘরে। তারপর অন্ধকারের সুযোগে কুকর্মের সময় ব্যবহার করা নোংরা জিনিস ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে আশেপাশের বাড়ির বাগানে। এসব আর কত সহ্য করব?” সীমা দেবী আরো কি বলছেন শুনুন ….
পূর্ব মেদিনীপুরের খড়গপুর আর দুর্গাপুরে এই আধুনিক বাইজি আনার নেপথ্যে কারবারের আসল নাটের গুরু কলকাতার একটি কোম্পানি। সেই কোম্পানির নিরাপত্তার রক্ষী পুলিশের সামনেই বুক ফুলিয়ে প্রতিবেশীদের তোলা সব অভিযোগ ফুত্কারে উড়িয়ে দিয়ে কার্যত তাদেরকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চাইছিলেন। ওই নিরাপত্তা রক্ষী দিব্যেন্দু কোলে বলেন, “ব্যবহৃত জিনিস ফেলার জন্য আমাদের এখানে তো ডাস্টিনের ব্যবস্থা আছে। দরকার হলে দেখে নিতে পারেন।”
তার কোম্পানির আমদানি করা ওইসব বাইজিদেরকে দিব্যেন্দু আবার শিল্পী তকমা দিয়ে কি কি বললেন শুনুন ….
রাতের পর রাত মদের আসরে কোমর দোলানো মেয়েরা যখন শিল্পীর মর্যাদা পায়, সেপকো, সেল কো-অপারেটিভ এর মত প্রাক্তন ইস্পাত কর্মীরা তখন কার্যত অসহায়। দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার প্রায় গায়ে গা লাগায় রয়েছে কাদারোডের নিষিদ্ধপল্লীটি। তারা আক্ষেপ করে বললেন, “এখনকার পুলিশ প্রশাসন তাহলে আমাদের ঘরের দুয়ারে এবার কাদারোড বস্তি বানাতে চাইছে । তাই নতুনরূপে নিষিদ্ধপল্লী শুরু হচ্ছে আমাদের এলাকাতে ?’ তাদের মতে – “এরা কেমন শাসক দল যারা এত নোংরামি দেখেও মুখে কাপড় গুঁজে তামাশা দেখছে। কাউকে কি ভয় পাচ্ছে বলেই প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার সাহস পাচ্ছেন না তারা?”
স্থানীয় বাসিন্দাদের এমন আশঙ্কা এবং অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্গাপুর নগর নিগমের মুখ্য প্রশাসক অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমি যা সব ঘটছে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। যে শহরে আমরা কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অনুষ্ঠান করে সুস্থ সংস্কৃতি ধরে রাখতে চাইছি, সেখানে হঠাৎ করে আবার ডান্স বর, সিঙ্গিং বার কি করে চালু হলো তা এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না। এ ব্যাপারে গত সপ্তাহে নিজের উদ্যোগ নিয়ে আসানসোল গিয়ে জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। জেলাশাসক বিষয়টি শিগ্রি হস্তক্ষেপ করবেন জানিয়েছিলেন।” বলে রাখা ভালো, শহরের সিটি সেন্টার এ ২০১৩ সালে একটি শপিংমলে আচমকাযই এইরকম বাইজি নাচের আসর বসার পর তৎকালীন নগর নিগমের মেয়র ও পুলিশ একযোগে ব্যবস্থা নিয়ে তা উঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সপ্তাহ কাল কেটে গেল শহরের গভীর রাত পর্যন্ত সূরা নারীর বাইজি পাড়ায় ব্যবসা না থেমে বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি বাড়ছে বাইজি, বাউন্সারদের দাপট। দুর্গাপুরের মহকুমা শাসক সৌরভ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “একটি অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ পাঠিয়ে ওখান থেকে ওই মেয়েদের গ্রেপ্তার করানো হয়েছিল।” সেপকোর সেই বাড়ির প্রহরী দিব্যেন্দু কোলে নিজের মুখে কবুল করলেন দুর্গাপুরে এইরকম তাদের আরো আটটি বাইজি নাচের ঠেক রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর অবধি কোন ডান্সবারেরই ব্যবসা আদতে বন্ধ হয়নি। কিন্তু কেন এমন লাগাম ছাড়া কারবার? দুর্গাপুরে শাসক দলের হাত কি তবে এদের মাথার ওপরে রয়েছে – এমন সম্ভাবনার কথা এক কথায় উড়িয়ে দিয়ে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বুধবার বলেন, “আমি এইরকম একটি অভিযোগ পেয়ে সেইদিনই পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। তারপর অবশ্য কাজের চাপে আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।” তিনি বললেন, “এখন যখন জানলাম পুলিশকে আবার বলবো যা যা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার তা নিশ্চিত করতে। এসব অসামাজিক কাজ কিছুতেই বরদাস্ত করা যাবে না।”
এখন প্রশ্ন পুলিশ তবে কি করছে? এ বিষয়ে একটি প্রশ্নের উত্তরে আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার অভিষেক গুপ্ত বলেন, “নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেব। কাউকে বলুন থানায় গিয়ে একটা অভিযোগ করতে।” কথা হল তাহলে নগর নিগমের মুখ্য প্রশাসকের অভিযোগ বা বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অভিযোগ গুলো কি যথেষ্ট ছিল না? পুলিশের বক্তব্যের পর এবার এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গেল।






