জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, পূর্ব বর্ধমান -: একসময় বলা হতো পৃথিবীটা টাকার বশ। একশ্রেণির মানুষের শয়নে, জাগরণে শুধু একটাই চিন্তা – টাকা। তাদের কাছে – টাকা জ্ঞান, টাকা ধ্যান, টাকা চিন্তামণি। কিন্তু আজ সেসব কিছুকে পেছনে ফেলে দিয়ে প্রযুক্তি কেন্দ্রিক পৃথিবীর বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুখ্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে স্মার্টফোন।
মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ তাদের ক্রমে বাইরের জগত থেকে বিমুখ করে তুলছে। তারা মাঠে খেলাধুলো করেনা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়না। ভাই-বোনেরা হইহুল্লোড় করে বাড়ি মাথায় করে রাখেনা। সবার দৃষ্টি ওই মুঠোফোনের স্ক্রিনে আবদ্ধ। এতে তারা ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে এক অনিশ্চিত অন্ধকারময় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তারা মায়া-মমতাহীন যন্ত্র মানবে পরিণত হবে। দেখতে মানুষের মত হলেও যেখানে মানবিক গুনাবলীর চরম অভাব দেখা দেবে।
ঠিক এই জটিল পরিস্থিতিতে বর্ধমান শহর থেকে কয়েক কিমি দূরে অবস্থিত হাটগোবিন্দপুরের ‘সমবেত প্রয়াস’ নামক নাট্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী তাদের রজত জয়ন্তী বর্ষে এক অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করে। গত ২৪ শে অক্টোবর সংস্থার ২৬ তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে ৫-১৫ বছরের কিশোর-কিশোরীদের জন্য আয়োজন করে নাটকের কর্মশালা। হাটগোবিন্দপুর মানগোবিন্দ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আয়োজিত এই কর্মশালায় ৪৮ জন কিশোর-কিশোরী অংশগ্রহণ করে। প্রশিক্ষক হিসাবে ছিলেন সুপরিচিত নাট্য ব্যক্তিত্ব অনির্বাণ বিশ্বাস।
কর্মশালাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই ছিল সাজো সাজো রব। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে উপেক্ষা করে পার্শ্ববর্তী গ্রামের অভিভাবকরা নিজ নিজ সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে সকাল সাড়ে নটার মধ্যে হাজির হন বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে।
অভিনয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো মনঃসংযোগ। মঞ্চে হাজার ওয়াটের নিয়ন আলো, সামনে হাজার হাজার দর্শকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মাঝে মনঃসংযোগ বজায় রাখতেই হয়। তাই আনন্দের মাধ্যমে কীভাবে মনঃসংযোগ বৃদ্ধি করা যায় সেটা দিয়েই কর্মশালার কাজ শুরু হয়। এরপর একে একে তাদের নাটকের বিভিন্ন ভঙ্গিমা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অবাক হয়ে অভিভাবকরা দেখেন তাদের দুষ্টু সন্তান বাধ্য ছাত্রের মত সবকিছুই অনুসরণ করে চলেছে। হাসি, আনন্দ ও প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে কীভাবে যে সাতটা ঘণ্টা কেটে যায় তার টের পাওয়া যায়না।
সংস্থার পক্ষ থেকে জানা গ্যালো তাদের লক্ষ্য একদিনের কর্মশালা নয়, রজত জয়ন্তী বর্ষে ছোটদের নিয়ে তাদের আরও অনেক কাজ করার ইচ্ছে আছে। তাদের মূল লক্ষ্য হাটগোবিন্দপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিশোর-কিশরীদের জন্য এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া যেখানে তারা মনের মত নিজেদের ছেলেবেলা তৈরী করতে পারবে। ভবিষ্যতে তাদের জন্য নিয়মিত নাটকের ক্লাসের আয়োজন করা হবে।
কর্মশালায় ‘সমবেত প্রয়াস’ এর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন সম্পাদক গুণময় রায়, সভাপতি ড. রণজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ প্রায় সকল সদস্য।
গুণময় বাবু বললেন, আমাদের লক্ষ্য মোবাইলের আকর্ষণ থেকে দূরে সরিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে খেলার মাঠমুখী ও সমাজমুখী করে তোলা। আমরা চাই, যন্ত্র নয় তারা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক। যেভাবে অভিভাবকরা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছেন তাতে আমরা নিশ্চিত আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবেই।