স্টাফ রিপোর্টার, দুর্গাপুর: অবশেষে সিবিআই’র কব্জায় সেই নেপালী সঞ্জয়। গত জুলাই মাসেই এক বিধায়ককে হুমকির অভিযোগে রাজ্য পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল।
চিটফান্ড কাণ্ডের তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদও চলছে, এরই মাঝে মঙ্গলবার দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর ভাড়াটিয়া বাসিন্দা সঞ্জয় কুমার সিং ওরফে নেপালী সঞ্জয়কে ডেকে পাঠানো হয় সিবিআইয়ের কলকাতাস্থিত সিজিও কম্প্লেক্সের দপ্তরে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তদন্তে অসহযোগিতা ও তথ্য গোপন করার অভিযোগে এদিন সকালে তাকে গ্রেপ্তার করে সিবিআই ও আসানসোল মহকুমা আদালতে পেশ করে পাঁচ দিনের হেফাজতের চাওয়ার অনুরোধ জানায় বিচারককে। সিবিআই কোর্ট অবশ্য এদিন তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। সিবিআই সূত্রে জানা যায় সঞ্জয় কুমার সিং এর কাছে থেকে সিবিআই প্রচুর নথি পেয়েছে ও তার দ্বারাই আর্থিক লেনদেন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে একসময় বর্ধমান সানমার্গ নামে একটি চিটফান্ড কোম্পানি কয়েকশো কোটি টাকা রাজ্যের বিভিন্ন জেলার আমানতকারীদের কাছ থেকে এজেন্টদের মাধ্যমে লাগাতার তুলেছিল। দুর্গাপুরের আমানতকারীদের কাছ থেকে নেপালী সঞ্জয় ও তার কয়েকজন সহযোগীর মাধ্যমে নগদে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা প্রতারণা করে তোলা হয় বলে অভিযোগ। অভিযোগ দায়েরও হয়েছিল অনেক আগেই। সূত্র মারফত জানা গেছে এই বর্ধমান সানমার্গ কোম্পানিতে উচ্চ পদেই ছিলেন সঞ্জয় সিং উরুফে নেপালী সঞ্জয়। স্থানীয় সূত্র মারফত জানা গেছে, বর্ধমান সানমার্গের নামে কয়েকশো বিঘা জমি দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল লাগোয়া এলাকায় তারই হেফাজতে রয়েছে, শুধু তাই নয় কয়েক কোটি টাকাও বেনামে তার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছে লগ্নি করা আছে। প্রায় দু দশক আগে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে বর্ধমান সানমার্গেরও আগে ‘সিস্টেম’ নামক এক আর্থিক প্রতারনার কারবার শুরু করে বেশ কয়েকজন। যার আখড়া ছিল ইস্পাত নগরীর কয়েকটি পাড়ায়। একটির পর একটি চিটিংবাজির বেপরোয়া কারবারের এই সিস্টেম তদানিন্তন বাম আমলে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের অলিতে গলিতে। দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর বি-জোন এলাকাতেই প্রথম এরকম একটি ‘সিস্টেম’ কোম্পানি খোলেন তানসেনের কূটন নন্দী নামক এক ব্যক্তি। তারপর দুর্গাপুর এস এন বোস এলাকায় আরেকটি চিটিংবাজী সংস্থা খোলেন জগৎময় ঘোষ নামক আরেক ব্যক্তি। এদের পথেই শহরের সিটি সেন্টারে আরেকটি প্রতারক কোম্পানি খুলে বসেন শান্তনু চক্রবর্তী নামে ইস্পাত নগরীর এক যুবক। দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীরই সেপকো টাউনশিপ এ আরেকটা ধাপ্পাবাজি সংস্থা খুলে বসেন রাজিব ঘোষ নামের আরেক ব্যক্তি। এইসব চিটিংবাজি সংস্থাগুলি মিলিত ভাবে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের কয়েক হাজার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কয়েকশো কোটি টাকা লুঠ করে রাতারাতি পালিয়ে যায় শিল্পাঞ্চল ছেড়ে। এই কারবারে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে প্রতারনায় হাত পাকায় শিলিগুড়ি থেকে আসা এই নেপালী সঞ্জয়। সিস্টেমের টাকার এক ‘বিশ্বস্ত’ জিম্মাদার হয়ে ওঠে এই নেপালী সঞ্জয়। এক সিস্টেম কর্তা খুন হয়ে যাওয়ায়, তার গোপন সম্পদের কার্যত ‘মালিক’ই হয়ে ওঠে নেপালী, যার হদিশ এখনো পায়নি আমানতকারী, তদন্তকারী – কেউই। “চিটফাণ্ডের তদন্তে সিবিআই সঞ্জয়কে গ্রেপ্তার করেছে বটে, কিন্তু তাতে ওরা সিস্টেমে ওর লুঠ করা সম্পদের হদিশ পাবেকি?” – প্রশ্ন শহরের সিনিয়র সিটিজেন্স ফোরামের কার্যকর্তা পিযূষ মজুমদারের। তার সওয়াল, “নেপালী সঞ্জয়ের মত ঠগেরা অগুন্তি সাধারণ আমানতকারীর কোটি কোটি টাকা নির্বিচারে হজম করে সাধু সেজে সমাজের ওপরতলার বাবুদের সাথে ওঠাবসা করে আসছিল এতদিন। তাদের কাছে সর্বস্ব হারিয়ে বহু মানুষ এখন ফুটপাতে দিন কাটাচ্ছে। অনেকের সারা জীবনের সঞ্চয় চলে গেছে। অনেকের মেয়ের বিয়ে আটকে গেছে, ছেলের পড়া বন্ধ হয়ে গেছ, বউ এর চিকিৎসা থেমে গেছে আর ওরা খোশ্ মেজাজে ফুর্তি করে বিলাসিতায় জীবন কাটাচ্ছে। সিবিআই ধরলেই শুধু হবেনা, প্রতারিতদের সুরাহার ব্যবস্থা করা দরকার।”
সিস্টেম কর্তাদের আচমকা গা ঢাকা দেওয়ার ঠিক বছর খানেকের মধ্যেই দুর্গাপুরের এ বি এল টাউনশিপ সংলগ্ন জাতীয় সড়কের পাশ থেকে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার হয় এক সিস্টেম কর্তা শান্তনু চক্রবর্তীর। অভিযোগ, তাকে কলকাতা থেকে ডেকে দুর্গাপুরে এনে ইস্পাত নগরীর বি-জোন এলাকার একটি স্কুল ঘরে কয়েকদিন আটক করে রাখে এক রাজনৈতিক মদদপুষ্ট গুন্ডা। তারপরই শান্তনুকে খুন করে জাতীয় সড়কের ধারে তার মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয়, বলে পুলিশের গোয়েন্দা সূত্র জানায়।
এদিকে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের একটি সূত্র মারফত জানা গেছে চিটফাণ্ড জালিয়াতিতে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের ২৬ জনের নামে অভিযোগ ইতিমধ্যেই তাদের কাছে রয়েছে। ধাপে ধাপে সেই সমস্ত অভিযুক্তদের একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। সংস্থার কলকাতার দপ্তরের সূত্র মারফত জানা গেছে, দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর এক রাজনৈতিক মদদপুষ্ট মাস্তান সহ দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর সরকারি জমিতে বিশাল কালীবাড়ি অবৈধভাবে নির্মাণকারী দুই ভাইয়ের নামও নাকি তাতে রয়েছে । এছাড়াও, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক নেতার খাস চামচা, বেলচা সহ বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক ও বেশ কয়েকজন ‘মুখোশধারী’ সমাজসেবীর নামও রয়েছে এই তালিকায়। নেপালী সঞ্জয় গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই চিটিংবাজি সংস্থার সাথে যুক্ত এই সব ব্যক্তিরা এখন গা বাঁচানোর রাস্তা খুঁজছেন। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন বিজেপির শীর্ষ স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, যাতে ‘ওয়াশিং মেশিনে’ তাদের ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া যায় বিজেপিতে যোগদানের মাধ্যমে। একটি সূত্র জানিয়েছে, নেপালী সঞ্জয়ের হেফাজতে সিস্টেম সহ বর্ধমান সনমাগ্রের প্রায় একশ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সিটি সেন্টারের একটি অফিসে গত কয়েক মাস ধরে এক হোটেল ব্যবসায়ীর চেম্বারে রীতিমতো ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল এই নেপালী সঞ্জয়। সপ্তাহে অন্তত তিনদিন দুপুর ৩ টার পর তার ঠিকানা ছিল ঐ সরকারি অফিসে ঐ হোটেল ব্যবসায়ীর সদ্য পাওয়া চেম্বার।
তবে কি এবার সিবিআই এর রাডারে ঐ হোটেল ব্যবসায়ীও ?