মনোজ সিংহ, দুর্গাপুর: নগরের খাসতালুকেই মাসাধিক কাল ধরে অবাধে প্রাণঘাতী ডেঙ্গুর চাষ করছে প্রভাবশালীদের জাঁকজমকের পূজো। সবাই দেখছে, বুঝছে কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে মুচকি হেসে কেটে পড়ছে। বড় বড় লোকেদের পূজো বলে কথা!
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে দিন দিন উদ্বেগ বাড়ছে রাজ্য সরকারের। চলছে দফায় দফায় স্বাস্থ্যকর্মী, আধিকারিকদের নিয়ে লাগাতার বৈঠক। জমা জল নিকেষ করার ফরমানও জারি হয়েছে রাজ্যজুড়ে, পাড়ায় পাড়ায়। তাতে কি ? বেফিকির রাজ্য সরকারেরই জামাই আদরে ঘরের থেকে ডেকে এনে পদে বসানো কিছু কর্তা ব্যক্তির। হাতে গরম যার নজির মিলেছে শহর দুর্গাপুরের খাস তালুক সিটিসেন্টারের বুকেই। তবে, তা নিয়ে অবশ্য বিশেষ হেলদোল নেই শহরের পুরনিগম থেকে স্বাস্থ্য দপ্তরের। কারণটা কি আসলে ওই জমানো জলে ডেংগু চাষের নেপথ্যে থাকা কোন এক প্রভাবশালীর লজ্জা ঢাকার চেষ্টা ?
সিটি সেন্টারের বুকে ধুমধাম করে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে চতুরঙ্গ কমিটির দুর্গাপুজো। শিল্পাঞ্চলের পুজো কমিটিগুলির মধ্যে বেশ জনপ্রিয় এই পুজো, যার উদ্বোধন করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ৫ অক্টোবর। এ বছর এবারের সরকারি কার্নিভালে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পুজোগুলির মধ্যে চতুরঙ্গ পুজো কমিটি শহরের বহু জনপ্রিয় পূজাকে টপকে তৃতীয় পুরস্কার পায়, যার পুরস্কার মূল্য এক লক্ষ টাকা। এবারে চতুরঙ্গ পুজোর প্যান্ডেলের থিম ছিল গুজরাতের নীলকন্ঠ মন্দির। আর ওই মন্দিরের প্যান্ডেলটির চৌহদ্দির ভেতরেই লাইভ জলাভিষেকের বিশেষ আয়োজন করা হয়েছিল। যার জন্যে সুদূর বেনারস থেকে খাতির করে নিয়ে আসা হয় একদল পুরোহিতকেও। এবারের পুজোর সময় চতুরঙ্গের প্যান্ডেলে ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু ওই লাইভ জলাভিষেক দেখার জন্যই ঠাসা ভিড় করে দাঁড়িয়ে থেকেছেন শহরবাসী। জলাভিষেকের জন্য প্যান্ডেলের ভেতরেই নন কোম্পানি ক্লাবের বিতর্কিত ওই খেলার মাঠে ৪০০ বর্গফুটের ৮ ফুট গভীর একটি পুকুর খনন করা হয়, যা আদ্যন্ত ছিল জলে টইটম্বুর। ওই জলের বুকেই ছিলেন নৃত্যরত নটরাজ, যার শিরস্থান থেকে বেরিয়ে আসা জলের ফোয়ারা নয়ন ভরে দেখেছে মানুষ। তবে, শহরবাসীর অনুমানও করতে পারেনি যে সরকারি নীতি নির্দেশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চতুরঙ্গ কমিটি হেলায় কিভাবে আসলে কৌশলে মারন ডেঙ্গুর চাষ করে চলেছে গত মাসাধিক কাল যাবত।
সরকারি নির্দেশে কার্নিভালের পর ঠাকুর বিসর্জন হয়েছে গত ১৪ই অক্টোবর – প্রায় ২৬ দিন আগে। কিন্তু, এই ৯ নভেম্বর সকালেও চতুরঙ্গ মাঠের বুকে ঠাই দাঁড়িয়ে পুজো প্যান্ডেলের পেল্লাই কাঠামো আর তার ভেতরে টলটলে জলের পুকুরটিতে জমেছে শ্যাওলা, আবর্জনা যা ডেঙ্গুর মশার আতুরঘর বলেই চিহ্নিত।
দুর্গাপুজোর পর কালীপুজো যেতে না যেতেই আবার ওই মাঠেই শুরু হয়েছে জগদ্ধাত্রী পুজো। অথচ, জলাভিষেকের সেই জলভরা পুকুরটি এখনো স্বমহিমায় বিরাজ করেছে এদিন দুপুর অব্দি। মাঝে পুকুরটির জল মারার নিষ্ফল চেষ্টা হয় একটি নালা কেটে। কিন্তু, অর্ধেকের একটু বেশি জল মেরে ওই নালাটি তার কর্মক্ষমতা হারায়। ফলে, জল আর মরেনি। ওই জল মারার জন্য একটি পাম্প দরকার ছিল। কিন্তু, “প্যান্ডেলের ইলেকট্রিক কানেকশন কেটে দেওয়ায় তাই আর পাম্প চালানো যায়নি,” বলে জানালেন পুজো কমিটির সদস্য জ্যোতি ভৌমিক।
রাজ্যজুড়ে ডেঙ্গু নিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতার মাঝেও চতুরঙ্গ এতটা উদাসীন কেন ? অথচ তা কি কাঙ্ক্ষিত ছিল ? চতুরঙ্গ পুজো কমিটির সভাপতি ব্যবসায়ী কবি দত্ত যিনি আবার রাজ্য সরকারের সংস্থা আসানসোল দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের বর্তমান চেয়ারম্যান, তিনি আবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ। তাই তার কাছ থেকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করেছিল শহরবাসী। অথ, তার পুজোতেই এমন সর্বনাশ! যে পুজো আবার সরকারি কার্নিভালেও শহরের অন্যতম সেরা!!
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইতস্তত কবি দত্ত বলেন, “অবশ্যই ওই পুকুরটি পুজোর পরপরই বুঝিয়ে ফেলা উচিত ছিল। এটা সত্যিই ভুল কাজ হয়ে গেছে।” তার কথায়, “আমি যাদেরকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তাদেরও এসব দেখা উচিত ছিল। শুনেছি কোন একটি মেশিন পাওয়া যায়নি বলেই ওই সমস্যা হয়েছে।”
কি সেই মেশিন? এডিডিএ’র চেয়ারম্যান চাইলে যেখানে আস্ত একটি কারখানা হাজির হতে পারে যখন তখন, সেখানে একটি মেশিন গত এক মাসেও জুটলো না চতুরঙ্গের? নাকি, তিনিও উদাসীন ছিলেন?
শুধু কি তিনিই ? সিটি সেন্টারের ওয়ার্ড থেকে গত পুরভোটে জিতেছেন দুর্গাপুর নগর নিগমের চেয়ারপারসন অনিন্দিতা মুখার্জি। তিনিইবা তাহলে এতটা উদাসীন কেন ? তার জবাব, “এটা হেলথের ইস্যু।ওটা তো রাখি দেখে।”
হ্যাঁ। নগরনিগমের অন্যতম প্রশাসক রাখি তেওয়ারি দেখেন স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়। প্রভাবশালীর পুজো বলেই কি তিনিও তবে উদাসীন ? বিশেষত বাড়ি বাড়ি গিয়ে তার সার্ভেয়াররা জমা জল দেখলেই যখন গৃহস্থকে ধমকাচ্ছেন, সেখানে রাখি চতুরঙ্গকে এক মাস ধরে ছেড়ে রাখলেন কেন? জলাভিষেকের পুকুরটিতে শনিবারও হাঁটু জল জমে। রাখির কথায়, “জলে ডেঙ্গুর লার্ভা খুঁজতে লাগাতার বাড়ি বাড়ি সার্ভে করা হচ্ছে। পুজো কমিটি যখন জলটা পরিষ্কার করলই না তখন আমাদের টিমের লোকেরা মাঝেমাঝে ওখানে স্প্রে করে আসছে। কি আর বলবো,!” বাড়িতে জমা জল থাকলে গৃহস্থদের নোটিশ পাঠিয়ে জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরো নিগম। তাহলে জেলার অন্যতম সেরা ওই পুজোর জন্য আলাদা নিয়ম কেন ? প্রভাবশালীর পুজো বলেই – এ প্রশ্ন শহর জুড়েই। এদিকে, রাখি জানান, “চতুরঙ্গ পুজো কমিটিকে সাত দিনের সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে ওরা ওই জমা জল পরিষ্কার না করলে এবার নোটিশ ধরাবো ওই পুজো কমিটিকে।”