নিজস্ব প্রতিনিধি, দুর্গাপুরঃ রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়েই কোনও এক ব্যক্তির বলা কথা আজ বড়ো কানে লাগছে। তিনি বলেছিলেন, “দেখ! গোটা শহর জুড়ে যত না গাছ আছে তার কয়েকগুন বেশি বোধহয় বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং শহর দুর্গাপুরকে গ্রাস করে নিয়েছে।” বাস্তবে নজর ঘোরালেই সকলেই এককথায় স্বীকার করে নেবেন কথাটা কিন্তু তিনি একবিন্দুও বাড়িয়ে বলেননি। বর্তমানে দুর্গাপুর শহর জুড়ে বিজ্ঞাপনী হোর্ডিংয়ের যা অবস্থা তাতে পরিবেশ দূষণের আগে জায়গা করে নিয়েছে দৃশ্যদূষণ। শহরের কলকারখানার দূষণকেও এই দৃশ্যদূষণ পেছনে ফেলে দিয়েছে। সম্প্রতি দুর্গাপুর নগর নিগমের তরফে শিল্পাঞ্চল জুড়ে বৈধ ও অবৈধ বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং চিহ্নিতকরন এবং সেই সমস্ত বৈধ সংস্থাগুলির কাছ থেকে বকেয়া রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও প্রাথমিক পদক্ষেপেই হোঁচট খাই দুর্গাপুর পুরসভা। সংস্থাগুলির তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং সংক্রান্ত মামলা কলকাতা হাইকোর্টে এখনও বিচারাধীন। তাই আদালতের রায় আসা পর্যন্ত কোনও রাজস্ব মেটানোর প্রশ্নই নেই। অগত্যা মুখ থুবড়ে পড়ে দুর্গাপুর পুরনিগমের সেই উদ্যোগ। সেইসঙ্গে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকার রাজস্ব কর আদায়ের কাজও। এরকম পরিস্থিতিতে চ্যানেল এই বাংলায়-এর তরফে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে অবৈধ হোর্ডিংকে কেন্দ্র করে যে লক্ষ লক্ষ টাকার দূর্নীতি চলছে তার অন্তর্তদন্ত শুরু করা হয়। আর সেই তদন্ত শুরু হতেই বেরিয়ে আসে অবৈধ হোর্ডিং ব্যবসা এখন বাস্তুঘুঘুর আড্ডা। কীভাবে হচ্ছে এই হোর্ডিং ব্যবসার কালোবাজারি? কারাই বা জড়িত এই বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে? এর সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। প্রথমে শুরু করা যাক দুর্গাপুর স্টিল টাউনশিপ থেকেই। গোটা টাউনশিপ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দুর্গাপুর ইস্পাত কর্তৃপক্ষের বহু হোর্ডিং। সেইসমস্ত হোর্ডিংয়ে শুধুমাত্র ইস্পাত মন্ত্রকের নিজস্ব বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্যই ব্যবহার করা হয়। এরপর বিভিন্ন সংস্থার তরফে ওইসমস্ত হোর্ডিংয়ের পাশে ডিএসপি কর্তৃপক্ষের বৈধ অনুমতি নিয়ে বিজ্ঞাপন হোর্ডিং সংস্থাগুলি তাদের হোর্ডিং বানায়। যতদূর জানা যায়, এক-একেকটি হোর্ডিং বানাতে ইস্পাতের বিম থেকে শুরু করে লোহার কাঠামো তৈরি করা ও তা মজবুত করে দাঁড় করিয়ে রাখতে কংক্রিট ব্যবহার করে খরচ পড়ে প্রায় দেড় থেকে দুলক্ষ টাকা। এই পর্যন্ত সবঠিকঠাকই চলে। খেলা শুরু হয় ঠিক এর পর থেকেই। ওই বৈধ হোর্ডিংয়ের গা ঘেঁষেই দাঁড় করানো হয় সম উচ্চতা ও দৈর্ঘ্যের আরও একাধিক হোর্ডিং। যা লাগায় দুর্গাপুরের বেশ কিছু বিজ্ঞাপনী এজেন্সিগুলি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কীভাবে রাতারাতি দাঁড় করানো হল এই বিশাল বিশাল হোর্ডিং? কেনই বা বৈধ হোর্ডিং ব্যবহারকারী সংস্থাগুলি এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে সরব হলেন না? আমাদের অন্তর্তদন্তে উঠে এসেছে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর। জানা গেছে, বৈধ হোর্ডিংয়ের মতোই সমপরিমাণ খরচ করে এই অবৈধ হোর্ডিংগুলি লাগানো হয়েছে বৈধ অনুমতি না নিয়েই। তাহলে কার অনুমোদনে বেআইনি হোর্ডিং লাগানোর ছাড়পত্র মিললো? আমরা জানতে পেরেছি বেশ কিছু এলাকার ক্লাব তাদের নিজেদের দায়িত্বেই এই অনুমতি দিয়েছেন এককালীন মোটা টাকার বিনিময়ে। শুধু তাই নয়, তাদের হোর্ডিংগুলি যাতে সুরক্ষিত থাকে তার জন্য নিয়মমাফিক দিতে হয় মাসোহারাও। সেই টাকার অঙ্কটাও মোটেও কম নয়। এককালীন ক্ষেত্রে সেই টাকা ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা এবং মাসোহারার ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে বৈধ হোর্ডিং সংস্থাগুলি এই বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছে। কিন্তু ফলস্বরূপ সেই রাতেই সেইসমস্ত সংস্থার বিজ্ঞাপনী ফ্লেক্সও হয় ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে আর না হলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে লোহার কাঠামোও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে বৈধ হোর্ডিং সংস্থাগুলি আর কোনও অভিযোগ জানাতে সাহস করেনি। শুধু ক্লাবগুলিকে দোষারোপ করলেও পক্ষপাতিত্ব করা হবে। আমাদের তদন্তে উঠে এসেছে এলাকার বহু প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতারাও এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং তারাও নিয়মিত এই ব্যবসা থেকে পকেট ভরে চলেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে সবকিছু জানা সত্ত্বেও কেন দুর্গাপুর ইস্পাত কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে কেন কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছেন না? আমাদের তদন্তে উঠে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। দুর্গাপুর ইস্পাত কর্তৃপক্ষের টাউন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কিছু অসাধু আধিকারিক বৈধ হোর্ডিংয়ের নম্বরগুলি ওই সমস্ত অবৈধ হোর্ডিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের কাছে ফাঁস করে দিচ্ছেন এবং তার বিনিময়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তাঁরাও। তবে সব আধিকারিকই যে দুর্নীতিগ্রস্ত সেকথাও ঠিক নয়, এমন অনেক আধিকারিক আছেন যারা সরেজমিনে ঘটনার তদন্তে গিয়েছেন। কিন্তু কিছু করতে পারনে নি তার একটি অন্যতম কারণ হল ওই সব হোর্ডিংগুলিতে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের বিজ্ঞাপন লাগানো থাকায়। তাঁরা যদি তা খোলার চেষ্টা করেন তখনই সেই সমস্ত এলাকার ক্লাব সদস্যরা ও স্থানীয় রাজনৈতিক কিছু অসাধু নেতা বাধা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে শুধু ফাইলে অভিযোগ জমা করে ফাইলের সংখ্যা বাড়ানো হয়। প্রতিটি বৈধ হোর্ডিংয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য বড় বড় করে বিজ্ঞাপন সংস্থার নাম ও মোবাইল নম্বর দেওয়া থাকে। যাতে যেসমস্ত সংস্থার বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন তারা যাতে যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল, অবৈধ হোর্ডিংগুলিতেও নাম না দিয়ে শুধুমাত্র বড় বড় করে মোবাইল নম্বর দেওয়া হয় বিজ্ঞাপনদাতাদের যোগাযোগ করার জন্য। অনেকের মনে এই প্রশ্ন নিশ্চয় আসবে কেন বিজ্ঞাপনদাতারা বৈধ হোর্ডিং থাকতে অবৈধ হোর্ডিংয়ে বিজ্ঞাপন দেবেন? উত্তর একটাই। শুধুমাত্র লাভের আশায়। কারণ, বৈধ হোর্ডিংয়ে বিজ্ঞাপন দিতে গেলে সরকারের সমস্ত নিয়মনীতি মেনে মোটা টাকা ট্যাক্স হিসেবে দিতে হয় ও বিজ্ঞাপন দেওয়ার খরচও অনেক বেশি। কিন্তু অবৈধ হোর্ডিংয়ে সেইসবের কোনও বালাই নেই। তাই বেশি সংখ্যক বিজ্ঞাপনদাতারাই কম পয়সায় সমপরিমাণ দর্শকের কাছে পৌঁছাতে ওইসব অবৈধ হোর্ডিংয়ে বিজ্ঞাপন দেন। ফলে প্রত্যেক মাসে বিজ্ঞাপনী রাজস্ব বাবদ সরকারের ক্ষতি হয় কয়েক লক্ষ টাকা। পুরো টাকাটাই লেনদেন হয় নগদে। তাই তা কালো টাকা হিসেবেই গণ্য করা হয়। রাজ্যের এই রাজস্ব ক্ষতি যারা করছেন এবং রাজ্যকে যারা বঞ্চিত করছেন নিজের পকেট ভরার স্বার্থে, তাদের সমস্ত মুখোশ খুলতে চ্যানেল এই বাংলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চ্যানেল এই বাংলায়-এর পক্ষ থেকে এই তদন্তে প্রায় ২০০টিরও বেশি অবৈধ হোর্ডিংয়ের হদিশ পাওয়া গেছে। কোন কোন বেআইনি বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ক্লাব, ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এর সাথে জড়িত তার একটা চিত্র আমাদের কাছে উঠে এসেছে। আমাদের পরের প্রতিবেদনে আমরা ইস্পাত নগরীর ভেতরে অবস্থিত ওই সমস্ত বেআইনি হোর্ডিংগুলির বিস্তারিত ছবি সহ তথ্য দিয়ে জনগণের সামনে পরিবেশন করব। সঙ্গে থাকবেন এই আশা রাখি।