মনোজ সিংহ, খড়গপুরঃ- পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে একমাত্র বন্ধুত্বই এমন একটি সম্পর্ক যা জাতি, ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে দুই জন মানুষকে এক হৃদয়, এক প্রাণ করে তোলে। গোটা বিশ্ব সহ ভারতবর্ষের একাধিক জায়গাতে এমন অনেক বন্ধুত্বের কাহিনী রয়েছে যা বারবারই প্রমান করে এ সম্পর্কে স্বাদ যে না পেয়েছে তার জীবনটাই বৃথা।

পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুর শুধুমাত্র রেলস্টেশনের জন্যই বিখ্যাত নয়, বিখ্যাত হয়েছে আরেক শিক্ষাক্ষেত্রের তীর্থভূমি আইআইটি খড়্গপুরের জন্য। ভারতবর্ষ সহ সারা পৃথিবী থেকে সোনার টুকরোর সমান ছাত্র-ছাত্রীরা এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে গোটা বিশ্বকে জয় করেছে। তবে আজকের আমাদের মূল কাহিনীর চরিত্র হলো এমন এক নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব যা আজকেও সম্মান, স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখা হয়েছে। ভারতবর্ষের বিখ্যাত ক্রিকেট তারকা মহেন্দ্র সিং ধোনির আন্তরিক বন্ধুত্বের কাহিনী আজ আপনাদের জন্য রইল রেল শহর খড়গপুর থেকে।

রেল শহর খড়্গপুরের রেল কলোনির মধ্যেই রয়েছে সাউথ ইনস্টিটিউট কমিউনিটি হল। আর এর ঠিক বাম পাশেই রাস্তার উপরে গাছ তলার নিচে টিনের ছাউনিতে রয়েছে এক বিখ্যাত চায়ের দোকান।খড়্গপুরের বাসিন্দারা ওই চায়ের দোকানটিকে ‘থমাস টি স্টল’ বলেই জানেন। খড়গপুর শহরে বেড়াতে আসা বহু মানুষের কাছে এই ‘থমাস টি স্টলটি’ এক দর্শনীয় স্থান হয়ে গিয়েছে। ৫৫ বছর বয়স্ক থমাস নামক এক ব্যক্তি হলো এই চায়ের দোকানের মালিক। আপনাদের সবার হয়তো মনে প্রশ্ন জাগছে এমন কি এই চায়ের দোকান যার জন্য খড়্গপুরে আশা সমস্ত পর্যটক একবার হলেও এই স্থানে এসে চা খেয়ে যান। না,এমন কিছু বিখ্যাত নয় চা এই দোকানে। কিন্তু এই দোকানে রয়েছে এমন এক বন্ধুত্বের কাহিনী যা মানুষকে আজও মনে করিয়ে দেয় নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও স্নেহের বন্ধুত্ব কত মূল্যবান।

পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুরে আমরা সকলেই হয়তো জানি মহেন্দর সিং ধোনি তার জীবনের প্রথম কর্মস্থল হিসেবে খড়্গপুর রেল জংশনই চাকরি পেয়েছিলেন। তেমন সচ্ছল পরিবারের থেকে তিনি না থাকার ফলে প্রায় সময়ই তার আর্থিক অনটন লেগেই থাকতো। খুব ভোর থেকে উঠে অনিমেষ গাঙ্গুলীর তত্ত্বাবধানে ক্রিকেট প্র্যাক্টিস ও পরে রেল স্টেশনে কর্মস্থলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে একপ্রকার বিধ্বস্ত হয়ে পড়তেন মহেন্দর সিং ধোনি। তিনি খড়্গপুরে থাকাকালীন বসবাস করতেন খড়গপুর রেল কলোনিতে অবস্থিত সুবর্ণরেখা ও কংসাবতী নামক দুটি গেস্ট হাউসের পেছনে অবস্থিত একটি ছোট্ট স্টাফ কোয়ার্টারের মধ্যে। খড়গপুর রেল জংশনে কর্মরত থাকা অবস্থায় যখনি তিনি কিছুটা ফাঁকা সময় পেতেন তখনই আসতেন এই থমাসের চায়ের দোকানে। থমাসের তখন খুব একটা বড় চায়ের দোকান ছিল না। ছোট্ট ঘুমটি চায়ের দোকানে বসে সমবয়সী থমাসের সাথে হঠাৎই বন্ধুত্ব হয়ে যায় মহেন্দর সিং ধোনির। যত দিন যায় তাদের বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হতে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মারফত জানা গেছে, বহুবার আর্থিক অনটনে পড়লে থমাসের কাছ থেকে টাকা ও ধার নিতেন মহেন্দর সিং ধোনি, পরে তা আবার তিনি ফিরিয়েও দিতেন সময় মত। এইভাবেই এক সাধারণ চায়ের দোকানের মালিক থমাসের সাথে নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে মহেন্দর সিং ধোনির।

কয়েক বছর পরেই ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হয়ে গোটা বিশ্বকে তার ২২ গজের খেলায় আপ্লুত করে তোলেন মহেন্দর সিং ধোনি। গোটা পৃথিবীজুড়ে মহেন্দ্র সিং ধোনির নাম ছড়িয়ে পড়ে। মাহি নাম শুনেই ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যে এক শিহরণ জাগিয়ে তুলতো তখন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় গোটা বিশ্বে জগত জোড়া নাম হয় তার। মহেন্দ্র সিং ধোনি কিন্তু তখনো ভুলে যাননি তার হতদরিদ্র থমাস নামক বন্ধুকে। একবার কলকাতায় একটি আন্তর্জাতিক খেলার শেষে হঠাৎই থমাসের ছোট্ট চায়ের দোকানে এসে হাজির হন মহেন্দর সিং ধোনি। দুজনের মধ্যে আবার পুরনো স্মৃতিচারণ হয়। মহেন্দর সিং ধোনির অনুরোধে খড়গপুর রেল ডিভিশনের ডি.আর.এম থমাসকে একটি স্থায়ী চায়ের দোকান করার অনুমতি দেন রেল কলোনির ভেতরেই।

মহেন্দর সিং ধোনি সারা পৃথিবীজুড়ে খেলার সময় যখনই সময় পেতেন তখনই ফোন মারফত খোঁজখবর নিতেন পুরনো বন্ধু থমাসের। কয়েক বছর আগেই হঠাৎ মহেন্দর সিং ধোনি জানতে পারেন তার প্রাণের বন্ধু থমাসের ‘সেলিব্রাল অ্যাটাক’ হয়েছে। এই খবর শোনা মাত্রই তিনি তার নিজের উদ্যোগে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা খরচা করে একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে সুস্থ করে তোলেন প্রাণের বন্ধু থমাসকে। কিন্তু থমাস আজ হারিয়ে ফেলেছে বাকশক্তি। সেলিব্রাল অ্যাটাকের ফলে তিনি আর কথা বলতে পারেন না। কিন্তু মহেন্দার সিং ধোনির বন্ধুত্ব আজও প্রাণের চেয়ে বেশি প্রিয় থমাসের, তাই দোকানের সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে থমাস ও মহেন্দর সিং ধোনির ছবি। স্বার্থপর এই দুনিয়াতে আজও মহেন্দ্র সিং ধোনি ও থমাসের মতন মানুষের বন্ধুত্ব নতুন করে বাঁচাতে শেখায়। ‘চ্যানেল এই বাংলায়’ পক্ষ থেকে মহেন্দর সিং ধোনি ও থমাসের দীর্ঘায়ু কামনা করে ও তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন যেন সারা পৃথিবীকে নতুন করে বন্ধুত্ব করার উদ্দেশ্যে উদ্বুদ্ধ করে সেই কামনা করে।

